২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে প্রকল্পের নামে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কী পরিমাণ অর্থ লোপাট ও দুর্নীতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করেছে অন্তবর্তী সরকার। সেই কমিটি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একাধিক প্রকল্পকে অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়-স্ফীত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কমিটি জানিয়েছে, ২১টি চলমান আইসিটি প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিলে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এটি এসব প্রকল্পের ১৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ।
পর্যালোচনা কমিটির প্রধান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে অপ্রয়োজনীয়, ব্যয়-স্ফীত এবং বৈষম্যমূলক উপাদান বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। আরও অনেক সাশ্রয় করা যেত, যদি আগেই এত বেশি অর্থ ব্যয় করে ফেলা না হতো।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সিনেপ্লেক্স ও আইসিটি পার্কের বানানোর পরিকল্পিত স্থানগুলোর একটি ছিল তার নিজ জেলা নাটোর। নাটোর শহরে একটি আইসিটি ইনকিউবেশন সেন্টার অব্যবহৃত পড়ে থাকা সত্ত্বেও একই জেলার সিংড়া উপজেলায় আরেকটি আইটি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।
এছাড়া রংপুর, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের ছয়টি সিনেপ্লেক্স নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯০ কোটি টাকা।
অযৌক্তিক প্রকল্পের তালিকা এখানেই শেষ নয়। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবন নিয়ে ১০টি সিনেমা নির্মাণে ৩৭০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব এবং ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি গ্রামকে আইওটি-ভিত্তিক 'ডিজিটাল গ্রামে' রূপান্তরের পরিকল্পনাও ছিল। এসব পরিকল্পনা পলকের সময় আইসিটি বিভাগে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা হয়।
আইসিটি সচিব শীশ হায়দার চৌধুরী বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার একেবারে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করেছি। আরও খরচ পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
পর্যালোচনা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দুটি বিদেশি অর্থায়িত প্রকল্প—এস্টাবলিশড ডিজিটাল কানেক্টিভিটি (ইডিসি) এবং এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (এজ)—থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
ইডিসি প্রকল্পের অধীনে গ্রামীণ এলাকায় (শিক্ষা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহ) এক লাখ ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদানের জন্য বরাদ্দ ৩০০ কোটি টাকার বেশি বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পর্যালোচনা কমিটির মাহবুবুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে চারটি সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাইবার অপটিক সংযোগ স্থাপনে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ অবকাঠামো দুটি কোম্পানির সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় দেওয়া হয়, যেখানে সরকারের জন্য মোট আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ রাখা হয়।
মাহবুব বলেন, বাকি কাজগুলো ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীরা বাণিজ্যিকভিত্তিতে অনেক কম খরচে করতে পারত। ইতোমধ্যে ক্রয়কৃত সরঞ্জামগুলো ৭০–৮০ শতাংশ বেশি দামে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
একইভাবে, ১০টি ডিজিটাল গ্রাম নির্মাণ বাতিল করলে ৫০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হবে। বাকি হাজার হাজার গ্রাম কি দোষ করল?' প্রশ্ন করেন পর্যালোচনা কমিটির প্রধান।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে একীকরণ না করে নাগরিকদের বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দত্তক গ্রহণ এবং মৃত্যুর কারণ সংক্রান্ত ডেটা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন সিস্টেম নির্মাণের পরিকল্পনায় বরাদ্দ ৩০০ কোটি টাকা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় বা কম লাভজনক অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোর ফলাফল হতাশাজনক ও অস্বচ্ছ থাকায় এগুলোও সমালোচনার শিকার হয়েছে।
মাহবুব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তি ল্যাব নির্মাণসহ এজ প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ বাদ দিতে হবে। এর আগে বিভিন্ন প্রকল্পে এ ধরনের সুবিধার জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আরও প্রয়োজন কেন?
এখন পর্যন্ত কেরানীগঞ্জ হাই-টেক পার্কে একটি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কারণ এটির কাজের অগ্রগতি অনেক বেশি হয়েছে। রংপুর, গোপালগঞ্জ ও নাটোরসহ বাকি পাঁচটি বাতিল হলে প্রায় ৯০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
পর্যালোচনা কমিটির মতে, অনেক প্রকল্পের অংশ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। 'কিছু কিছু প্রকল্প আইসিটি বিভাগের দায়িত্বও ছিল না,' পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পলক অন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই তাদের ব্যবহারের জন্য এটুআই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৭–১৮টি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন বলে জানান মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, আগে তৈরি করুন এবং পরে অন্যদের এটি ব্যবহার করতে বাধ্য করুন ছিল তার নীতি। দুর্বল সমন্বয় এবং দ্রুততার সঙ্গে জিনিসপত্র ক্রয়ের কারণে খারাপ ফলাফল ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, ২০১৯ সালে প্রাক্তন আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের চালু করা একটি অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম 'একপে' এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটরের লাইসেন্স পায়নি।
ঠাকুরগাঁওয়ে আইটি পার্ক নির্মাণের জন্য অন্যান্য সরকারি অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও নতুন জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
কমিটির এক সদস্য জানান, পলকের নেতৃত্বে আইসিটি বিভাগ আরও ডজনখানেক আইটি পার্ক, ইনকিউবেশন সেন্টার, কম্পিউটার ল্যাব, ট্রেনিং সেন্টার এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা চেয়েছিল। অথচ পূর্বের প্রকল্পগুলো ঠিকমতো চলছিলই না। এসব প্রশ্ন কেউই তোলেননি।
সম্ভাব্যতার অভাবে বান্দরবান, পটুয়াখালী ও ঠাকুরগাঁওয়ের নিকটবর্তী শহর থেকে অনেক দূরে তিনটি আইটি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক আ ক ম ফজলুল হক জানান, এখন পর্যন্ত তুলনামূলক কম অর্থ ব্যয় হওয়ার কারণে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এবং সিলেটের চারটি হাই-টেক পার্ক বাতিল করা হয়েছে।
এছাড়া, নির্মাণাধীন হাই-টেক পার্ক ভবনগুলোর উল্লম্ব বৃদ্ধি বন্ধ করেও তহবিল সাশ্রয় করা হবে।
কমিটি আরও জানায়, গেমিং ও অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি অপচয় হয়েছে, কারণ প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপগুলো ব্যবহার করা হয়নি অথবা প্রশিক্ষণার্থীরা যথাযথ দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। তারা এ ধরনের ব্যয় বন্ধের এবং পুনরাবৃত্তি না করার সুপারিশ করেছে।
নারীর ক্ষমতায়নের প্রকল্পে সুবিধাভোগী নির্বাচনেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পর্যালোচনায়।
তাড়াহুড়ো করার কারণে পরিকল্পিত বিদেশি তহবিল নিশ্চিত করার আগেই জিনিসপত্র কিনে ফেলার ঘটনাকে কমিটি 'প্রকল্প শৃঙ্খলার-বহির্ভূত' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এদিকে, কিছু প্রকল্প প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কারণ এসব প্রকল্পের নির্ধারিত অনেক সুবিধাভোগী ইতোমধ্যে বিকল্প উপায়ে সুবিধা পেয়ে গেছেন, বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইসিটি নীতি উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তাইয়েব।
তিনি আরও জানান, চলমান প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ চলছে।
আইসিটি প্রকল্পের ব্যয় কয়েক কোটি টাকা থেকে শুরু হয়ে গত এক দশকে কয়েকশ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। তবে গত চার-পাঁচ বছরে এর আকার কয়েক হাজার কোটিতে পৌঁছায়।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ১৫–১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫টি প্রকল্পের পরিকল্পনা ছিল। এসব প্রকল্পের কিছু কিছু দেখে কমিটির সদস্যরা অবাক হয়েছেন।
যেমন, শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের মহিমান্বিত করতে ১০টি সিনেমা নির্মাণের জন্য ৩৭০ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অপ্রাসঙ্গিক ও ব্যয়বহুল বলে মনে করে।
২৫টি অননুমোদিত পরিকল্পনার মধ্যে আটটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে কমিটি এবং অন্যগুলোর আকার অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
আগস্টের শেষ দিকে কমিটি গঠনের এক সপ্তাহের মধ্যে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম হতাশা প্রকাশ করেন যে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইসিটি বিভাগের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান, রুয়ান্ডা এবং ঘানার মতো দেশের তুলনায় ডিজিটাল প্রস্তুতির আন্তর্জাতিক সূচকে পিছিয়ে রয়েছে।
সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: ইমরান খান
কার্যালয়: গ-১৩৩/৩, প্রগতি স্মরণী, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। মোবাইল: ০১৮৫৩-৫৪৬২৫৪
প্রিয়দেশ নিউজ কর্তৃক সর্বসত্ব ® সংরক্ষিত