অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান শিক্ষাব্যবস্থা

8

বিবি চাঁদ সুলতানা: করোনা অতিমারিতে পুরো বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেরও আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক তথাপি সামগ্রিক দিক ক্ষতিগ্রস্ত। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোচনীয় অবস্থায় আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এই সংকটকালীন অবস্থায় আমাদের মূল বিবেচ্য নাগরিক সুস্থতা আর অর্থনীতি কেন্দ্রিক হয়ে উঠলেও শিক্ষাখাত থেকেছে পুরোপুরি উপেক্ষিত। যেটা শিক্ষার্থীদের কে ঠেলে দিচ্ছে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা চিন্তা করে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু এর পুরো সময়টা জুড়ে সীমিত কিংবা স্বাভাবিক পরিসরে চলমান আছে অন্য সকল প্রতিষ্ঠান, বিশেষত যেগুলো অর্থনীতি কেন্দ্রিক। শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই স্থবিরতা আমাদের শিক্ষার্থীদের এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য কতটা হুমকিস্বরুপ হবে সেটাই এখন নতুন শঙ্কা জাগ্রত করছে।হ্যাঁ এটা ঠিক শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু রাখার জন্য অনলাইন ক্লাসের প্রস্তাবনা ও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অনলাইন ক্লাস পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা কার্যকর হচ্ছে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিপাত নেই। অনলাইন শিক্ষা সামগ্রী ও টেকনোলজিগত অপ্রতুলতার কারণে বৃহৎ সংখ্যক শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে গুণগত শিক্ষা থেকে। এই অনলাইন ক্লাস পদ্ধতি শহুরে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য হলেও, গ্রামে বসবাসকারী শিক্ষার্থীরা যাদের ভালো নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট এবং বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য কতটা কার্যকরী সেটা প্রথম থেকেই প্রশ্ন জাগ্রত করে এসেছে।

এই পরিস্থিতিতে দুই -তিনমাস মাস পার করা গেলেও এক বছর অনেক বড় একটি সময় ক্ষতিপূরণের জন্য।ক্লাসরুম, ক্যাম্পাস, স্বাভাবিক জীবনে ছেড়ে দীর্ঘদিনের গৃহবন্দি জীবন আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা উঠে এসেছে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধ থেকে। ২৬ আগষ্ট ২০২০ এ journals.plos.org তে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশের ৮৮% শিক্ষার্থী হতাশা গ্রস্থ এরমধ্যে ৪৭% ইক্সট্রিম। Anadolu Agency নামক তুর্কী ভিত্তিক নিউজ এজেন্সিতে প্রকাশ করা হয় যে, বাংলাদেশে করোনার থেকে বেশি মানুষ (৭০%) মারা যাচ্ছে আত্মহত্যার জন্য। যার ভেতর ৪৯% হলো শিক্ষার্থী।আচল ফাউন্ডেশন এর একটি পরিসংখ্যান, ১৩ মার্চ ২০২১ এর প্রথম আলোর একটি রিপোর্টে প্রকাশিত হয়, গত এক বছরে দেশে মোট আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪ হাজার ৪৩৬ জন যার ভেতর অধিকাংশের বয়স ১৯-৩৫ বছর অর্থাৎ শিক্ষার্থী। যেখানে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের দেশে মৃত্যুর সংখ্যা হলো ১২ হাজার ৩১০।করোনার আগের বছর আমাদের দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সিলিং এর ব্যাপার গুলোতে আমাদের আগ্রহ কম।করোনার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার জন্য আমাদেরকে সচেতন হওয়ার বার্তা দেয় এই পরিসংখ্যানগুলো।ওপর ওপর লকডাউন থাকলেও অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখার জন্য সকল কার্যকলাপ কিন্তু চলমান।

দেশি-বিদেশি গবেষকদের ধারণা,করোনা খুব দ্রুত বিদায় নিচ্ছেনা!জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এই বলে সতর্ক করছে যে, সময়ের সাথে করোনার নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে,করোনার টিকা কিন্ত আমাদের শতভাগ সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিচ্ছেনা।জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত করোনাভাইঅরাসের মোট টিকার ৭৫শতাংশ গেছে মাত্র ১০টি দেশের হাতে। ১৩০ টিরও বেশী দেশ এক ডোজ ও টিকা পায়নি। এএফপির বরাত দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক কর্মকর্তা এই বলে সতর্ক করেছেন যে, টিকা বন্টনের এই বৈষম্য চলতে থাকলে গোটা বিশ্ব মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এ সময় তিনি আরও বলেন,আজকের বিশ্বে কোন দেশই বিচ্ছিন্ন নয়,ফলে একটি দেশও যদি টিকার বাইরে থেকে যায়,তবে তা হবে সুইসাইডাল। ফলে এ কথার ভিত্তি কি যে টিকা দেওয়ার পর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। কেননা সরকারি হিসেবে,স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় চার কোটি টিকা শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। ফলে সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনতে কমপক্ষে চার কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন, আর ডাবল ডোজের হিসাব করলে আট কোটি টিকার প্রয়োজন। গত এক বছরে দেশে টিকা এসেছে মাত্র এক কোটি। আগামী তিন মাসে সিনোফার্ম থেকে আসবে আরো দেড় কোটি টিকা। ফলে আমাদের এটা সহজে অনুমেয় যে,এক সাথে সরকার চাইলেও দেশের সব শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারবেনা। সুতরাং আমাদের প্রয়োজন সংক্রমণের হার বিবেচনা করে অঞ্চল ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি আমাদের খুব একটা ভাবনায় ফেলছেনা, কেননা এর হিসাব প্রচলিত শিল্প প্রতিষ্ঠান কিংবা ঈদের বাজারে শপিং সেন্টার বন্ধ থাকার ফলে যে ক্ষতি তার মতো সহজে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।করোনাকালে অর্থনৈতিক ক্ষতির সরকারী বেসরকারী যত হিসাব করা হচ্ছে, তাতে কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অর্থনৈতিক কোন প্রভাব পড়েছে কি না তা জানানো হয়নি। এর ক্ষয়ক্ষতি ও প্রভাব বুঝতে হলে আমাদের কে তাকাতে হবে, আজ থেকে দশ বছর পরে,তখন আমরা বুঝতে পারবো, কিভাবে একটা প্রজন্মকে হত্যা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্যঝুঁকির দোহাই দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। শিক্ষার্থীরা কি আদৌ ঘরে নিরাপদ আছে? তার পরিবারের বাবা মা কিংবা অন্য সদস্যদের কিন্তু ঠিকই রোজ কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে, ভীড় হট্টগোল ডিঙিয়ে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। গণপরিবহন বন্ধ করে শপিংমল হাট বাজার অন্য প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে পরিস্থিতিকে আরো বেশি কঠিন করা হচ্ছে। এই সামগ্রিক পরিস্থিতে, মেয়ে শিক্ষার্থীদের বাল্যবিবাহ হচ্ছে, ছেলে শিক্ষার্থীরা নির্বাচনী মিছিলে সময় কাটাচ্ছে,রাত জেগে অনলাইনে জুয়া খেলছে যা তাদের ভবিষ্যৎ কে আরও বেশি হুমকির মুখে ফেলছে। এরকম সময় অনিশ্চিয়তা ও অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত আরও বেশি হাতাশা গ্রস্থ করে ক্ষতির সম্মুখীন করবে শিক্ষার্থীদের। সুতরাং শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে হলেও শিক্ষাঙ্গনে পাঠানো এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)