গুগল ও উইকিপিডিয়াতে টাইপিস্টের চাকরির কথা বলে নারীকণ্ঠে প্রলোভন দেখাত এক তরুণ। এ প্রলোভনে পড়া শতাধিক নারীর ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে গোপনে ভিডিও ধারণ করতেন তিনি। এরপর ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিতেন। এমন অভিযোগে আল ফাহাদ (১৯) নামের এক তরুণকে আটক করেছে র্যাব।
রাজধানীর গুলশানের নদ্দা এলাকায় গতকাল বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে আল ফাহাদকে আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে একটি দামি ক্যামেরা, দুটি ক্যামেরার লেন্স, একটি মোবাইল ফোন, ছয়টি সিমকার্ড, একটি এক্সটার্নাল মেমোরি কার্ড এবং ৪০৩ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। র্যাব কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতেন আল ফাহাদ।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, “করোনা মহামারির শুরু থেকেই অপরাধীরা ভার্চুয়াল জগতের অপব্যবহার করে বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রতারিত করছে। প্রতারকেরা বিভিন্নভাবে নারীদের হেনস্তা, প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলছে। ভুক্তভোগী অনেকে ‘রিপোর্ট টু র্যাব’ ও র্যাবের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি জানান। এছাড়া অনেকে র্যাবের কাছে সরাসরি অভিযোগ দেন। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে অভিযুক্তদের ধরতে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১-এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নৰ্দ্দা এলাকায় অভিযান চালায়। পরবর্তীকালে ভার্চুয়াল মেডিকেল স্ক্যানিংয়ের নামে গোপনে ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অপরাধে আল ফাহাদকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাহাদ জানিয়েছে, অসংখ্য নারীকে প্রতারণার মাধ্যমে অনেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।”
যেভাবে করা হচ্ছিল ব্ল্যাকমেইলিং
প্রথমে ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে অল্পবয়সি নারীদের দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন—গুগল-উইকিপিডিয়াতে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখাতেন আল ফাহাদ। এ সময় চাকরিপ্রত্যাশী অনেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁদের (চাকরিপ্রার্থী) প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা ‘রেজিস্ট্রেশন ফি’ নেওয়া হতো। এভাবে আল ফাহাদ অনেক চাকরিপ্রত্যাশীকে আকৃষ্ট করতেন।
অন্যদিকে, মোবাইলে বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে নারীকণ্ঠে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হতো। এ ছাড়া বিভিন্ন কৌশলে প্রার্থীদের করোনাকালীন সময়ে ‘ভার্চুয়াল মেডিকেল’ করা হবে বলে জানানো হতো। প্রার্থীদের (নারীদের) বিভিন্ন সামাজিক চ্যাটিং অ্যাপের মাধ্যমে ভিডিও কলে যুক্ত করত। এ সময় নিজের মোবাইলের ক্যামেরা বন্ধ রেখে ভিডিওকলে মেডিকেল পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলে কৌশলে ভুক্তভোগীদের গোপন ভিডিও ধারণ করতেন আল ফাহাদ। পরবর্তী সময়ে গোপনে ধারণ করা ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হত।
এভাবে অভিযুক্ত ফাহাদ শতাধিক নারীকে ব্ল্যাকমেইল করেছে বলে জানায় র্যাব।
চাকরিপ্রত্যাশীদের অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হতো। ফাহাদ নিজেই বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে কণ্ঠ পরিবর্তন করে নারীকণ্ঠে চাকরিপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে ‘ভুয়া নিয়োগ’ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন নারীর নাম ব্যবহার করে চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রথমে নিজেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বর্তন কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন আল ফাহাদ। একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাকরিতে যোগদান করেছেন বলেও জানাতেন। পরবর্তী সময়ে নিজেই ওই কোম্পানির অ্যাডমিন অফিসার হিসেবে বিভিন্ন নামে পরিচয় দিতেন এবং ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নিতেন। ফের ওই অ্যাপের মাধ্যমে কণ্ঠ পরিবর্তন করে নিজেই মেডিকেল অফিসার হিসেবে ভুক্তভোগীদের ভার্চুয়াল মেডিকেল করানোর নামে ভিডিও করতেন।
যেহেতু করোনাকালীন সময়ে হাসপাতালে গিয়ে মেডিকেল করা সহজ ছিল না, সে ক্ষেত্রে আটক ফাহাদ এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৌশলে ভিডিও করে ভুক্তভোগীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন।
কে এই ফাহাদ
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, আটক ফাহাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তিনি একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পরে লেখাপড়া ছেড়ে দেন। পরবর্তীকালে তার বাবার সঙ্গে রেলস্টেশনের পাশে একটি ফলের দোকানে বসতেন। ফল বিক্রির আড়ালে ফেসবুকে ‘অনলাইন জব বিডি’ ও ‘পার্ট-টাইম জবস ইন ঢাকা’ এবং ‘পার্ট টাইম জবস ইন বাংলাদেশ’ নামের গ্রুপে সদস্য হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে গ্রুপে দেশি-বিদেশি কোম্পানিতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চাকরি দেওয়ার নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করছিলেন। প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাজে ফেসবুকে বেশ কিছু নারীদের ভুয়া আইডি ব্যবহার করতেন তিনি।