নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি ফরজ ইবাদতগুলোকেই কেবল ফজিলতপূর্ণ মনে করা হয়। অথচ হাদিস শরিফে মানুষের এমন এক স্বভাবের কথা বলা হয়েছে, যার প্রতিদান বিস্ময়কর। এমনকি সেটি সহজে জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম। যে স্বভাবের ব্যাপারে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ঐ বান্দাকে জান্নাত দেওয়া ছাড়া আমি সন্তুষ্ট হবো না। সেটি কী?
সেটি হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ধৈর্যধারণ। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে বনি আদম, যদি তুমি ধৈর্যধারণ করো ও প্রথম আঘাতেই অধৈর্য না হয়ে তাতে সাওয়াবের আশা করো, আমি তোমাকে জান্নাত দেওয়া ছাড়া কোনো প্রতিদানে সন্তুষ্ট হবো না।’ (ইবনে মাজাহ: ১৫৯৭)
ধৈর্যকে সর্বোত্তম নেয়ামত আখ্যা দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তাকে ধৈর্যশীলতা দান করেন। ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোনো নেয়ামত কাউকে দেওয়া হয়নি।’ (বুখারি: ১৪৬৯) পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় ধৈর্যশীলদের অপরিমিত পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (সুরা জুমার: ১০)
ধৈর্যের এত বড় প্রতিদান কেন
অধৈর্যের পরিণতি দেখলে ধৈর্য কত মহান ইবাদত সেটি বুঝা যায়। জীবনের পদে পদে যত বিশৃঙ্খলা, হাঙ্গামা সবকিছুর মূলে অধৈর্য। তাই যারা ধৈর্যধারণ করেন তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে যান। অনেককে দেখা যায়, নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত সব ইবাদতে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন, কিন্তু মোটেও ধৈর্য নেই, কথায় কথায় রেগে যান। এর অর্থ হলো- তিনি প্রকৃত মুমিন হতে পারেননি। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। প্রিয়নবী (স.) সবচেয়ে বেশি ধৈর্যশীল ছিলেন। ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ হয়েও অবিশ্বাসীদের বহু জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে, তবুও তিনি সবসময় ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। মহান আল্লাহই তাকে অমূল্য নেয়ামত ‘ধৈর্য’ দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আপনি ধৈর্যধারণ করুন, আপনার ধৈর্য হবে আল্লাহর সাহায্যেই।’ (সুরা নাহাল: ১২৭)
মহান আল্লাহর কাছে ধৈর্যশীলরা এতটাই প্রিয় যে, ‘মহান আল্লাহ ধৈর্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন’ (সুরা বাকারা: ১৫৩)। তিনি ধৈর্যের বিনিময়ে পুরস্কার বাড়িয়ে দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের দুবার প্রতিদান দেওয়া হবে এ কারণে যে তারা ধৈর্যধারণ করে এবং ভালো দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করে। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। (সুরা আল কাসাস: ৫৪)
মহান আল্লাহ তার মুমিন বান্দাদের ধৈর্যধারণের তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ধরো ও ধৈর্যে অটল থাকো এবং পাহারায় নিয়োজিত থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হও।’ (সুরা আল ইমরান: ২০০)
বিপদে ধৈর্যধারণ করার কারণে গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়, একই সঙ্গে আল্লাহর রহমতও অর্জিত হয়। মসিবতে যে মহান প্রভুর প্রশংসা করে, আল্লাহ তাআলা বিনিময়ে তার উপর রহমত করেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তারা সে সব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা বাকারা: ১৫৭)
অতএব একজন মুমিন সুখের সময় যেমন শুকরিয়া করবেন, তেমনি দুঃখের সময় আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় সবর করবেন। হাদিসে এসেছে, মুমিনের বিষয়টি বড় আশ্চর্য রকমের, বিপদে পড়লে এতে সে ধৈর্য ধরে আবার সুখে থাকলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। তবে উভয় অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহিহ মুসলিম: ২৯৯৯)
প্রিয়বস্তু হারানোর পরও ধৈর্যশীল বান্দার জন্য জান্নাতে বিশেষ নেয়ামতের ঘোষণা দিয়ে নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন মহান আল্লাহ (জান কবজকারী) ফেরেশতাদের বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার সন্তানের প্রাণ হরণ করেছ কি? তারা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তোমরা তার হৃদয়ের ফলকে হনন করেছ? তারা বলেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বলেন, ‘সেসময় আমার বান্দা কী বলেছে?’ তারা বলেন, ‘সে আপনার হামদ (প্রশংসা) করেছে ও ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করেছে।’ মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার (সন্তানহারা) বান্দার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ করো, আর তার নাম রাখো ‘বায়তুল হামদ’ (প্রশংসাভবন)।’ (তিরমিজি: ১০২১)
অসুস্থ ব্যক্তির ধৈর্যের প্রতিদান সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে এসেছে- মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমি আমার মুমিন বান্দাকে রোগাক্রান্ত করি, আর বান্দা সে অবস্থায় আমার প্রশংসা করে আলহামদুলিল্লাহ বলে; তবে সে বিছানা থেকে এমনভাবে উঠে দাঁড়ায়; যেন তার মা তাকে ভূমিষ্টকালে যেমন জন্মদান করেছিল।’ (হাদিসে কুদসি)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব সামান্য ভয়, ক্ষুধা, জানমাল ও ফল-ফলাদির ক্ষতি দিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে যারা ধৈর্য ধারণ করবে, হে নবী! তুমি তাদের জান্নাতে সুখের দিনের সুসংবাদ দাও’ (সুরা বাকারা: ১৫৫।) মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘অতএব আপনি ধৈর্যধারণ করুন, যেমন ধৈর্যধারণ করেছেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসুলগণ।’ (সুরা আহকাফ: ৩৫)।
ধৈর্যশীলদের সফলকাম ঘোষণা দিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আজ আমি তাদেরকে তাদের ধৈর্যের কারণে এমন প্রতিদান দিয়েছি যে তারাই সফলকাম।’ (সুরা: মুমিনুন: ১১১)