দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই মানুষের নাভিশ্বাস, তার উপর শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়িক সংগঠন। গতকাল শনিবার তারা সমাবেশ বিবৃতি ও আলোচনায় এ প্রতিক্রিয়া জানান। তাদের মতে, মানুষের পেটে যদি ক্ষুধার আগুন থাকে, তাহলে তারা সংস্কারের কথা শুনবে না। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের মধ্যে শতাধিক পণ্যের উপর ভ্যাট বৃদ্ধি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে। তারা আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি যখন প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে তখন এমন ধরনের কর বাড়ানো দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলবে।
শতাধিক পণ্যের ওপর কর আরোপের ঘটনা আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, এতে সীমিত আয়ের মানুষ ভয়ঙ্কর চাপে পড়বে। ৫ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা কর বসানো সরকারের ভুল নীতি। এমন সিদ্ধান্তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হবে। গতকাল শনিবার সকালে নয়াপল্টনে দলটির দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। রিজভী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। তারা এখনো বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ। প্রতিদিনের সংসারের ব্যয় মেটাতে জনগণকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। তাতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ আরেক দফা বাড়ছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ বা সস, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান-ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পলের ওপর ভ্যাট হার বৃদ্ধি মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষকে আরও চাপে ফেলবে। রিজভী বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। দুর্ভোগ মেনে নিলেও জনগণ এখনো সরকারের বিরুদ্ধে তেমন উচ্চবাচ্য করছে না। কারণ জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল দেখতে চায়। কিন্তু সরকার নিজেরা নিজেদেরকে সফল দেখতে চায় কিনা, মানুষের ক্ষুধা নিবৃতির কার্যক্রমের মাধ্যমে সেটি তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবিদন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব এমরান সালেহ প্রিন্স, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান সেলিম, সহ-প্রচার সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন, নির্বাহী সদস্য আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী, তারিকুল আলম তেনজিং, স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ডা. জাহিদুল কবির জাহিদ প্রমুখ।
নতুন ভ্যাট অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করুন: জাতীয় নাগরিক কমিটি
শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য অন্তর্বতী সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই মুহূর্তে টিসিবির ট্রাক সেল চালু করারও দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির অবস্থান তুলে ধরেন সংগঠনটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। লিখিত বক্তব্যে আখতার হোসেন বলেন, শুল্ক বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি ও ব্যবসায়ের খরচ বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে নেমে না যায় এবং তাদের ভোগান্তি যাতে না বাড়ে। বিগত অবৈধ সরকার আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই কঠিন ঋণের শর্ত হিসেবে কয়েকটি ধাপে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে অন্তর্বতী সরকার সম্প্রতি এ অধ্যাদেশগুলো জারি করেছে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকারের কাছে প্রশ্ন অবৈধ সরকারের ঋণের এই শর্ত বর্তমান সরকার পুনর্বিবেচনার জন্য আইএমএফকে আহ্বান জানিয়েছে কি? এ বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
সংবাদ সম্মেলনে অবিলম্বে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক অধ্যাদেশ প্রত্যাহার ও টিসিবির ট্রাক সেল চালুর দাবির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী যদি দেশ চালানোর কথা ভাবেন, তাহলে আপনার সঙ্গে আমাদের লড়াই বাঁধবে। যদি বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শ মতো এমন সিদ্ধান্ত হয়, যা জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করবে, আমরা সেটা সাপোর্ট করবো না। মানুষের পেটে যদি ক্ষুধার আগুন থাকে, তাহলে তারা সংস্কারের কথা শুনবে না। টিসিবির ট্রাক বন্ধ, ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড বাতিল এবং শতাধিক পণ্যে শুল্ককর বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নাগরিক ঐক্য আয়োজিত মানববন্ধনে তিনি একথা বলেন।
অন্তর্বতী সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের। তিনি দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির জন্য সরকারের অদূরদর্শিতাকে দায়ী করেন। ভ্যাট, ট্যাক্স, ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তাতে পুরোনো ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি সরকারকে বলেন, ফ্যাসিস্টরা যেভাবে দেশ চালিয়েছে, সেই কায়দায় দেশ চালাবেন না। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সরকারের উদ্দেশে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও জানমালের হেফাজত করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন।
দেশ বর্তমানে একটি সংকটময় মুহূর্ত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যার মূল কারণ হলো; সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি ব্যয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণ প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতাসহ উচ্চ সুদহার। তাছাড়া বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতির বিদ্যমান এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে শতাধিক পণ্যের উপর ভ্যাট বৃদ্ধিসহ বেশকিছু পণ্যের কর হার বৃদ্ধি এবং শিল্পে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুনের বেশি বাড়ানোর উদ্যোগ ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। গতকাল শনিবার ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক