লেবাননের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ ইসরায়েলি হামলায় শুক্রবার নিহত হয়েছেন। দেশটির রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সদরদপ্তর লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়। এতে নাসরুল্লাহ ছাড়াও নিহত হয়েছেন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শীর্ষ আরও কয়েকজন কমান্ডার। এ ছাড়া ওই হামলার জেরে ধসে পড়ে অন্তত ছয়টি আবাসিক ভবন।
শনিবার হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে হিজবুল্লাহ। ৬৪ বছর বয়সী নাসরুল্লাহকে হত্যার পর হিজবুল্লাহ বলেছে, তাদের নেতা ‘শহীদদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন’ এবং ‘শত্রুর বিরুদ্ধে’ পবিত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে তারা।
হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এই প্রতিবেদনে সেসব প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো-
জাতিসংঘ
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, গত দিনে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে ইসরায়েল যে ‘নাটকীয় উত্তেজনা’ দেখাচ্ছে তাতে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সহিংসতার এই চক্র এখনই বন্ধ করতে হবে এবং সব পক্ষকে সংঘাত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গুতেরেস বলেন, লেবাননের জনগণ, ইসরায়েলের জনগণ এবং বৃহত্তর অঞ্চল সর্বাত্মক যুদ্ধের ভার বহন করতে পারে না। গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সেখানে আটক সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ডকে হাজার হাজার আমেরিকান, ইসরায়েলি এবং লেবাননের বেসামরিক নাগরিকের ভোগান্তির জন্য ন্যায়বিচার বলে অভিহিত করেছেন। বাইডেন হিজবুল্লাহ, হামাস, হুথি এবং অন্য যেকোনো ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে এই অঞ্চলে ‘মার্কিন সামরিক সহায়তা আরও উন্নত করার’ নির্দেশ দিয়েছেন।
হামাস
হিজবুল্লাহ নেতা হত্যার ঘটনাকে ‘কাপুরুষোচিত ও সন্ত্রাসী হামলা’ বলে নিন্দা জানিয়েছে হামাস। গোষ্ঠীটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই ইহুদিবাদী অপরাধ ও গণহত্যার মুখে আমরা আমাদের পরম সংহতি প্রকাশ করছি। হিজবুল্লাহ ও লেবাননের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আছি।’
ইরাক
ইরাকি প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি বোমা হামলাকে ‘লজ্জাজনক আক্রমণ’ আখ্যায়িত করে বলেন, হাসান নাসরাল্লাহ ধার্মিকদের পথে একজন শহীদ। ইরাকের প্রভাবশালী শিয়া মুসলিম নেতা মুক্তাদা আল-সদরও ৩ দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। ইরাকের সাদরিস্ট আন্দোলনের নেতা এক্স-এ লিখেছিলেন, ‘প্রতিরোধের পথের সঙ্গীকে বিদায় জানাই।
তুরস্ক
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান লেবাননে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি ইসরায়েলকে ‘গণহত্যা, দখলদারিত্ব ও আগ্রাসন’ নীতির অংশ হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্যান্য সংস্থার প্রতি সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
নাসরুল্লাহর নাম উল্লেখ না করে এরদোয়ান বলেন, তুরস্ক লেবাননের জনগণ ও তাদের সরকারের পাশে আছে এবং ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের জন্য সমবেদনা জানাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের আরও ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ অবস্থান দেখানো উচিত।
ফাতাহ
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ‘নৃশংস ইসরায়েলি আগ্রাসনের’ নিন্দা জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনি ফাতাহ আন্দোলন শোক প্রকাশ করে এবং ‘লেবাননের জনগণ এবং তাদের প্রতিরোধ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক’র ওপর জোর দেয়।
ইরান
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এক বিবৃতিতে বলেছেন, নাসরুল্লাহকে হত্যায় প্রতিরোধ আরও জোরদার করবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারে না।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হিজবুল্লাহ প্রধানের মৃত্যুতে ৫ দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। তিনি সব মুসলমানকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নাসরুল্লাহর রক্তের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। খামেনি বলেন, প্রতিরোধের মাধ্যমে এই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি এক্স-এ এক পোস্টে বলেছেন, ‘প্রতিরোধের নেতা হাসান নাসরুল্লাহর গৌরবময় সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। কুদস (জেরুজালেমের) মুক্তির ক্ষেত্রে তার পবিত্র লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে।
ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ নাসরুল্লাহকে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক’ বলে প্রশংসা করেছেন।
রাশিয়া
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে নাসরুল্লাহকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং লেবাননে আগ্রাসন বন্ধে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এই বলপ্রয়োগমূলক পদক্ষেপ লেবানন এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় নাটকীয় পরিবর্তন আনবে
হুতি
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা বলেছে, নাসরুল্লাহকে হত্যা ইসরায়েলি শত্রুদের মোকাবিলায় তাদের দৃঢ় সংকল্পকে শক্তিশালী করবে। এক বিবৃতিতে গোষ্ঠীটি বলেছে, হাসান নাসরুল্লাহ আত্মত্যাগের শিখা, উচ্ছ্বাসের উত্তাপ ও সংকল্পের শক্তি বাড়িয়ে তুলবেন।
লেবানন
লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি নাসরুল্লাহকে ইসরায়েলের হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটি লেবানন ও ওই অঞ্চলের সহিংসতা নতুন পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে।
জার্মানি
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, লেবাননের পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং পুরো অঞ্চলে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বেয়ারবক এক্স-এ লিখেছেন, ‘পরিস্থিতি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে। এটি কখনোই ইসরায়েলের সুরক্ষা ও স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে না।’
ফ্রান্স
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে তারা লেবাননের কর্তৃপক্ষ ও ওই অঞ্চলে ফ্রান্সের অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। বামপন্থী ফরাসি রাজনীতিবিদ ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য জ্যঁ-লুক মেলেনচন বলেন, এই হত্যাকাণ্ড লেবাননে আগ্রাসন ও যুদ্ধের দিকে আরও একটি পদক্ষেপ।