ভোলার মনপুরা উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী জাকির হোসেনের শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। তার নারায়ণগঞ্জে একটি বাড়ি, মোহাম্মদপুরে ফ্ল্যাট, মনপুরায় ইটভাটা ও মৎস্য ব্যবসায় ৮০ কোটির অধিক বিনিয়োগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ সম্প্রতি এই সংক্রান্ত একটি অভিযোগ জমা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, জাকিরের আয়কর প্রোফাইল অনুযায়ী তিনি ৯২ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৩ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ এবং উপহারের ২০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে। যা তার নির্বাচনী হলফনামার সাথে মিল নেই। ফ্ল্যাট ও বাড়ি ছাড়া ব্যবসায়ের মূলধন দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার ১১৮ টাকা যা দিয়ে তিনি গত অর্থবছরে ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা আয় করেছেন বলে মৎস্য ব্যবসা থেকে দেখিয়েছেন। মূলধন ৬ লাখ টাকা দিয়ে এক বছরে ৯ লাখ টাকা ব্যবসা করা একটি প্রতারণার গল্প ছাড়া কিছুই নয়।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তিনি তার বাড়ি, ফ্ল্যাট মিলিয়ে ৮৫ লাখ ৮০ হাজার ৭৫ টাকা ব্যাংক ও নগদ টাকা মিলে ৩০ লাখ টাকা। উপহারের স্বর্ণের দাম বাদে ১ কোটি ১৫ লাখ ৮০ হাজার ৭৫ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন। যা তার আয়কর প্রোফাইলের সাথে মিল নেই। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে বিগত কয়েক বছরে তিনি পদ-পদবী ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি সম্পদ লুট, সরকারি কাজে অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যান। তিনি ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তার অবৈধ সম্পদের পালে হাওয়া লাগে। তিনি একের পর এক ফ্লাট, বাড়ি, ইটভাটা, মৎস্য ব্যবসায় লগ্নি, শ্বশুরের আশুলিয়ার বাড়ি নির্মাণে বিনিয়োগ করেন।
জাকির হোসেন মোহাম্মদপুরে ৯৫ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনলেও তিনি দেখিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। তার ৮ শতাংশের জমিতে ২৯০০ স্কয়ার ফিট প্রতি ফ্লোর হিসেবে ৪ তলায় ১১৬০০ স্কয়ার ফিট নির্মাণ করতে তার দেড় কোটি টাকা খরচ হলেও তিনি আয়কর প্রোফাইলে তার বাড়ি নির্মাণ মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৫৪ লাখ টাকা। তিনি মৎস্য ব্যবসায় ১৫০টি নৌকা ও সাগরে মাছ ধরার ফিশিংবোট ভেদে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রতিটি নৌকা ও ফিশিংবোটকে দাদন (মাছ ধরার শর্তে সুদে ঋণ) দিয়েছেন। এছাড়াও তার নামে-বেনামে ১২ টি ফিশিংবোট রয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। যেগুলো সন্দ্বীপ, কক্সবাজা্রসহ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন জায়গায় মাছ আহরণের জন্য যায়, যার প্রতিটির মূল্য কোটি টাকার বেশি। তিনি মূলত নিজের কালো টাকা সাদা করার জন্য মৎস্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন।
জাকির হোসেন ইটভাটা প্রথমে পার্টনারসহ শুরু করলেও পরবর্তীতে তার পার্টনার বিক্রি করে দিলে ৫ কোটি টাকা দিয়ে পুরো অংশ কিনে নেন বলে জানিয়েছে তার ইটভাটা সংলগ্ন বদিউজ্জামান মাদ্রাসার পুর্ব পাশের মফিজল হাওলাদার। যেহেতু তিনি বৈধ আয় বহির্ভূত টাকা দিয়ে ইটভাটা কিনেছেন তাই জমির দলিল নেননি বলে জানা যায়।
বিদ্যুতের জমি কেনা ও বালু ভরাট
জাকির তার প্রভাব খাটিয়ে হাজিরহাটের সোলার গ্রিডের জমি কিনে দেয়ার নাম করে কোম্পানি থেকে অতিরিক্ত টাকা ও সাধারণ মানুষকে তাদের যথোপযুক্ত টাকা না দিয়ে জমি কেড়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও বালু ভরাটের জন্য বালুমহল থেকে বালু কিনে আনার নিয়ম থাকলেও। নিয়ম বহির্ভূত ভাবে মনপুরার উপকূলের কাছ থেকে বালু উত্তোলন করে অবৈধ ব্যবসা করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে হিয়েছেন অলে অভিযোগ রয়েছে। মনপুরার উপকূলের কাছথেকে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে মনপুরা দ্বীপ বলে স্থানীয়রা জানান।
ধর্ষকের সরদার
জাকিরের দখলবাজি, চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি কিছু মাস্তান পোষেন বলে জানা গেছে। তার মাস্তানদের মধ্যে অন্যতম ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা রুবেল শিকদার, কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাকিব, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নজরুল, ছাত্রলীগ নেতা এনাম। এদের মধ্যে রাকিব, নজরুল, এনাম চিহ্নিত ধর্ষক। এদের বিরুদ্ধে একাধিক ধর্ষণের মামলা রয়েছে জেল খেটেছেন একাদিকবার। জাকির চেয়ারম্যানের আশ্রয়ে তারা এসব করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি সম্পদ লুট
জাকিরের ইউনিয়নের বরাদ্দের নিম্নমানের কাজ করে ও অনেক ক্ষেত্রে কোন কাজ না করেই ১৩ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ভিজিডি, ভিজিএফসহ সাধারণ মানুষের জন্য আসা সরকারি চাল বিক্রি ও টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার ভাগিনা সোহাগের এজেন্ট ব্যংকের মাধ্যমে আসা বরাদ্দের টাকা কয়েকবার পুরো গায়েব করে দেন জাকির।
সাধারণ মানুষ লাঞ্ছিত
জাকির ২০০০ সালে বাংলাবাজারে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ষাটোর্ধ্ব করিম হোসেনকে লাঞ্ছিত করেন বলে স্থানীয় কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ জানান। তিনি করিম হোসেনের দাড়ি ছিঁড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাকিরের ভাই ইউসুফ সাধারণ মানুষের কাছে এক ভয়ংকর নাম। ইউসুফ সাধারণ মানুষকে সামান্য কারণেও লাঞ্ছিত করেন। বাংলাবাজারের পাহারাদার নুরালম ওরফে এলাচি হুজুরের বিরুদ্ধে মিথ্যা চুরির অভিযোগে প্লাস দিয়ে জিব্বা টেনে লাঞ্ছিত করেন বলে বাজার ব্যবসায়ী উসমান, সফিক, ছাত্তার জানান। তার ভগ্নিপতি জাহাঙ্গীর মেম্বার কর্তৃক চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক উপকারভোগীরা ঘুষ ছাড়া কোন সুবিধা পায় না। জাকিরের কাছে অভিযোগ করে সুরাহা হয়নি।বন বিভাগের সম্পদ বিনষ্ট
আলম বাজার সংলগ্ন বন বিভাগের বনের পূর্ব পাশে নতুন রাস্তা তৈরির সময় পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ না নিয়ে নদীর সাথে নিয়ম বহির্ভূতভাবে পাইপ দিয়ে সংযোগ করে দেন, যাতে সেখানে মাছ আহরণের জন্য লিজ দেয়া যায়। পরে ১৫ লাখ টাকা লিজ দেন বার্ষিক চুক্তিতে। যা সরকারি খাতে জমা দেননি। মাছ ধরার জন্য পানি জমাট রাখায় সেখানে বন বিভাগের ৩ হাজার এর অধিক গাছ মারা যায়। পানি জমাট রাখায় রাস্তা ভেঙে যায়। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কালভার্ট তৈরি করে মাছ আহরণের বেবস্থা করা হয়। এখন প্রতি বছর লিজ দেওয়া হয়। বন বিভাগ ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পায়নি।
ইটভাটায় সরকারি কাঠ পোড়ানো
জাকিরের ইটভাটায় বনবিভাগের গাছ পোড়ানো যেন সাধারণ বেপার। ইটভাটায় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কয়লা ব্যবহারের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত কোন কয়লা ব্যবহার করেনি। এছাড়া তার ইটভাটার অনুমতি নেই বলেও জানা গেছে। একাধিক সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে রিপোর্ট হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
আত্মীয়দের সম্পদ দখল
জাকির হোসেন যে শুধু সরকারি সম্পদ ও মানুষের সম্পত্তি আত্মসাৎ-জবরদখল করেন শুধু তাই নয়, তিনি নিজের আত্মীয় কবির মেম্বা্র, নাছির মিয়াসহ কয়েক জনের সম্পদ দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
ভাগিনা ও শ্যালকের ইয়াবা ব্যবসা
জাকির হোসেন শুধু দখল-টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করেই যে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তা নয়। তিনি মনপুরায় ইয়াবা ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যবসা নিজের ভাগিনা শামীম, সোহাগ এবং শ্যালক তানভীর দেখাশোনা করে। রমরমা ইয়াবা ব্যবসা থেকেও অবৈধ অঢেল টাকা আয় আসে। তার দুই ভাগিনা ও শ্যালক তানভীর মনপুরায় ইয়াবার বড় সাপ্লায়ার। এছাড়া তার ভাগিনাদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ।
ভাইকে ডামি প্রার্থী
জাকিরের ভাই সিদ্দিকুরকে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা তৈরির পায়তারা করা হচ্ছে। চাঁদাবাজ সিদ্দিকুর ব্যাংকে চাকরি করলেও তার টাকার উৎস মনপুরার চাঁদাবাজি। এজন্য তাকে ঢাকা থেকে নিয়ে ডামি প্রার্থী করে অতিরিক্ত এজেন্ট দিয়ে কেন্দ্র দখল করে বিশৃঙ্খলার পাঁয়তারার অভিযোগ রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ারম্যান প্রার্থী জাকির হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হলফনামায় ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগে মনোনয়ন বাতিলসহ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।