ক্যান্সার প্রতিরোধে যেসব খাবার গুরুত্বপূর্ণ

মনের অজান্তেই অনেকের শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি ক্যান্সার।তাই দিন দিন ক্যান্সার যেমন বাড়ছে, পাশাপাশি বাড়ছে এই রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা।

প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সচেতন রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে যথাযথ চিকিৎসায় ক্যান্সার পুরোপুরি সেরে যেতে পারে অথবা নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ হয়।

কাজেই ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। সচেতনতা, অর্থ ও সময়াভাবে শারীরিক অবস্থা খুব বেশি খারাপ না হলে রোগী ডাক্তারের শরণাপন্ন হন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেষ পর্যায়ে গিয়ে রোগ নির্ণয় হয় বিধায় ভালো চিকিৎসা সম্ভব হয়না। তখন ব্যয়বহুল চিকিৎসা -অস্ত্রোপচার, ঔষধ, পথ্য, হাসপাতালের বিল, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন বা হরমোনথেরাপি দিয়েও রোগীকে বাঁচানো যায় না। মৃত্যুতে রোগীর অসহ্য যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটালেও, সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়ে দেয় একটি দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারকে। ক্যান্সারের সাধারণ কিছু লক্ষণ : ১) অল্প অল্প বা বেশি জ্বর হওয়া, রাতে ঠান্ডা লাগা বা ঘেমে যাওয়া, ২) স্বাভাবিকের চাইতে বা অতীতের চাইতে ক্ষুধা কমে যাওয়া,

৩) শরীরের যে কোনও জায়গায় চাকা বা দলা দেখা দেয়া। কখনও এই চাকায় ব্যাথা হতে পারে, কখনও ব্যাথা নাও হতে পারে,

৪) দীর্ঘস্থায়ী কাশি থাকা, কোনও কিছুতেই না সারা। কিংবা অনেকদিন যাবত গলা ভাঙ্গা থাকা,

৫) মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন আসা। ঘন ঘন ডায়রিয়া,কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা মলের সাথে রক্ত যাওয়া,

৬) বিনা কারণেই খুব ক্লান্ত বোধ করা,

৭) অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যাওয়া,

৮) কোথাও কেটে গেলে অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া, এবং রক্তপাত বন্ধ হতে না চাওয়া,

৯) ত্বকের ওপরে কোথাও দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাওয়া। কোনও তিলন বা অন্য কোনও কিছুর আকার বা চেহারা পরিবর্তন,

১০) স্তনে ব্যথা হওয়া, কিংবা পুঁজ বের হওয়া,

১১) দীর্ঘদিন যাবত প্রচণ্ড মাথা ব্যথা থাকা। ক্রমশ ব্যথার পরিমাণ বাড়তে থাকা,

১২) ক্ষতস্থান শুকাতে না চাওয়া। এই লক্ষণ গুলোর মাঝে এক বা একাধিক লক্ষণ চোখে পড়া মাত্র ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন। মোটেও অবহেলা করবেন না। এক মুহূর্তের অবহেলা হয়ে উঠতে পারে আপনার জীবননাশের কারণ। ক্যান্সার প্রতিরোধক খাদ্য সমূহ: ১) মিষ্টি আলু বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ একটি সবজি। গবেষণায় দেখা যায় উচ্চমাত্রায় বিটা ক্যারোটিন শরীরে থাকলে তা কোলন, স্তন, পেট ও ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয়, যে নারীরা মিষ্টি আলুর মতো বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ সবজি তাদের খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন রাখেন তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় অর্ধেক কমে যায়।

২) সাওয়ারসপ: প্রাকৃতিক ক্যান্সার প্রতিরোধক সাওয়ারসপ ফল। আমরা কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানি। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সাওয়ারসপ ফল কেমোথেরাপির চেয়ে দশ হাজার গুণ শক্তিশালী। অতিরিক্ত না খেলে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। গাছের নাম গ্র্যাভিওলা। এর ফল ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন: সাওয়ারসপ, করোসল গুয়ানাবা, গুয়ানাভানা) ইত্যাদি। এই গাছের ফল, পাতা, ডাল, ছাল-বাকল এবং শিকড় ক্যান্সার সহ বহু রোগের নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।

৩) পত্র বহুল সবুজ শাক-সব্জী : পালং শাক, কেইল, কলার্ড গ্রীন, রোমেইন ও আরুগুলা লেটুস, ওয়াটার ক্রেস (হেলেঞ্চা শাক) সহ দেশীয় সবুজ শাক-পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ও মিনারেলগুলো, এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং এনজাইম। এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এছাড়াও আছে গ্লুকোসাইনোলেটস, এন্টিব্যাকটেরিয়াল ও এন্টিভাইরাল উপাদান এবং নিষ্ক্রিয় কার্সিনোজেনস। যা টিউমার সৃষ্টি রোধ, ক্যান্সার কোষ ধ্বংস ও ক্যান্সার স্থানান্তরণে বাধা প্রদান করে। কাজেই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সবুজ শাক-পাতা থাকা আবশ্যকীয়।

৪) ক্যাবেজ পরিবার ভুক্ত সব্জী: বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকোলি, ওলকপি, শালগম, ব্রাসেলস স্প্রাউটে আইসোথায়োসায়ানেটস নামক ফাইটোকেমিক্যাল আছে। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়াও ক্যান্সার দমনে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে অন্যান্য সব্জীও ভূমিকা রাখে, যেমন: পিয়াজ, জুকিনি, এস্পারাগাস, আর্টিচোকস, মরিচ, গাজর এবং বীট।

৫) বেরি জাতীয় ফল: ব্ল্যাক বেরি, ব্লু বেরি, স্ট্রবেরি, গোজীবেরি, রাস্পবেরি, চেরি, মালবেরি ও কামু কামু সহ বেরি জাতীয় সকল ফলে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট। ক্যান্সার নিরাময়ের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৬) উজ্জ্বল কমলা রঙের ফল ও সব্জী: কমলা, লেবু, জাম্বুরা, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, পেঁপে, গাজর ও স্কোয়াশ সহ উজ্জ্বল বর্ণের যাবতীয় ফল ও তরিতরকারি ক্যারোটিনয়েড এন্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। বিটা-ক্যারোটিন অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, ডিটক্সিফিকেশন ও ক্যান্সার রোধ করে।

৭) হলুদ: হলুদে বিদ্যমান ‘কারকিউমিন’ প্রদাহজনিত সমস্যা বিরোধী এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মানব দেহের টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দেহকে ক্যান্সার প্রতিরোধী করে তোলে। শরীরকে ক্যান্সার প্রতিরোধী করতে চাইলে কাঁচা হলুদ খেতে পারেন অথবা মাছ ও মাংসের তরকারিতে প্রয়োজন মতো ব্যাবহার করতে পারেন।

৮) অর্গানিক মাংস : কোনো প্রকার স্টেরয়েড, হরমোন ও এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ ছাড়া পালিত মুরগির কলিজা এবং তৃণভোজী গরুর মাংস ক্যান্সার রোগীর খাদ্য তালিকায় থাকা বাঞ্চনীয়। কারণ এই পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারে ভিটামিন বি ১২ আছে উচ্চ মাত্রায়। সেলেনিয়াম, জিংক ও বি ভিটামিন রক্ত পরিশোধন, হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়াও হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে। ৯) দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য : প্রক্রিয়াকরণ দুগ্ধজাত খাবার যেমন টক দই হলো প্রোবায়োটিক বা ভালো ব্যাক্টেরিয়ার উত্তম উৎস। প্রোবায়োটিক টিউমার বৃদ্ধি রোধ করে। গরু ও ছাগলের দুধ এবং পনিরে রয়েছে সালফার প্রোটিন ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট।

যা ক্যান্সার রোগীর খাদ্য তালিকায় রাখা জরুরি। দুগ্ধজাত খাবারে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি আছে। এই ভিটামিন ডি শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে ক্যালসিয়াম রেকটাল সহ নানা রকমের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এছাড়াও ব্রেস্ট এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

১০) মাছ : গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মাছের ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড -এন্টিইনফ্ল্যামেটরি, এন্টিটিউমার ও এন্টিক্যান্সার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বিষাক্ততা কমাতে ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ফলদায়ক ভূমিকা রাখে। তৈলাক্ত মাছ খাদ্য তালিকায় রাখুন।

১১) গ্রীন টি : ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর প্রধান কারণ মেটাস্ট্যাসিস বা ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়া। গ্রীন টিতে আছে পলিফেনোলিক কম্পাউন্ড, ক্যাটেচিন, গ্যালোক্যাটেচিন এবং ইজিসিজি (এন্টিঅক্সিডেন্ট)। যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, টিউমার বৃদ্ধি রোধ ও ক্যান্সার স্থানান্তরণ অর্থাৎ মেটাস্ট্যাসিস রুখে মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন গ্রীন টি পান করুন।

১২) মাশরুম: উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন মাশরুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মাশরুম রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৩) স্বাস্থ্যকর অপরিশোধিত ভোজ্য তেল: নারকেল তেল, তিসির তেল এবং এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল অন্ত্রে পুষ্টি যোগায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জলপাই তেলে রয়েছে ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস যা প্রদাহ কমায়। এমনকি ব্রেস্ট ও কলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

১৪) বাদাম ও বীজসমূহ : চিনাবাদাম ভিটামিন-ই এর সব থেকে ভালো উৎস।

ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ চিনাবাদাম কোলন, ফুসফুস, যকৃত এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। সকালে কিংবা বিকালের নাস্তায় চিনাবাদাম রাখুন।