

ক্লাসরুমে নয়, উপাচার্যের কার্যালয়েই যেন চালু হলো অনানুষ্ঠানিক ভাইভা—তফাত শুধু, প্রশ্ন ছুড়লেন ছাত্ররা, আর জবাব খুঁজে ফিরলেন উপাচার্য। “আপনাকে আমরা বসিয়েছি”—এই ঘোষণা দিয়ে একজন ছাত্র যেন মনে করিয়ে দিলেন, নিয়োগপত্রের আসল চাবিকাঠি কার হাতে। এমন দৃশ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নয়, তবে ক্যামেরাবন্দি হওয়ার পর তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। উপাচার্যের মর্যাদা, শিক্ষার্থীর শালীনতা—সবকিছুই যেন মেঝেতে গড়াগড়ি খেল সেই ৪ মিনিটের ভিডিওতে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারের কক্ষে সম্প্রতি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উপাচার্যের আসন ঘিরে কয়েকজন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান। একপর্যায়ে একাধিক শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, “আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি, আপনাকে আমরা বসিয়েছি, আপনি আমাদের কথা শুনতে বাধ্য।”
শনিবার (৫ জুলাই) সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের পদোন্নতি ঘিরে শুক্রবার বিকেলে উপাচার্যের কার্যালয়ে কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা হট্টগোল করেন। সেই সময় ভিডিওটি মুঠোফোনে ধারণ করা হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক নেতা তাহসান হাবীব উপাচার্যকে উদ্দেশ করে বলেন, “স্যার, আপনাকে আমরা বসিয়েছি, আপনি আমাদের কথা মানতে বাধ্য।” তখন উপাচার্য বলেন, “না।” এ কথা বলার পরপরই উপস্থিত শিক্ষার্থীরা হইচই শুরু করেন। পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের চবি শাখার সাবেক নেতা শাখাওয়াত হোসেন বলেন, “এখানে আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি।” এরপর তাহসান আবারও বলেন, “স্যার, আপনাকে আমরা এনে এখানে বসিয়েছি। আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি।” উত্তরে উপাচার্য বলেন, “কী করেছি আমি?” তাহসান বলেন, “আপনি কেন ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রমোশন দিচ্ছেন? আমাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করছেন।”
ঘটনার সময় শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে উপাচার্যের উদ্দেশে আঙুল উঁচিয়ে চেঁচামেচি করতেও দেখা যায়। একপর্যায়ে উপাচার্য উপস্থিত সাংবাদিকদের মুঠোফোনের ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতির সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তাঁর সাক্ষাৎকার বাতিল ও চাকরিচ্যুতির দাবিতে ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতাকর্মীরা গতকাল বিকেলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। সেখান থেকেই সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা উপাচার্য কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। একজন উপাচার্যকে তাঁর নিজ কার্যালয়ে এভাবে হেনস্তা করা এবং এমন ভাষায় কথা বলা কতটা শোভন—তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
এই বিষয়ে জানতে গতকাল রাত থেকে আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারের মুঠোফোনে একাধিকবার (কমপক্ষে ১০ বার) কল করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বিতর্কিত বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, “উত্তেজনার বশে কথাটি বলে ফেলেছি, ভেবে-চিন্তে বলিনি।”
অপরদিকে তাহসান হাবীব বলেন, “উপাচার্যের যোগ্যতা নেই—এমনটা বোঝাতে চাইনি। আমি বোঝাতে চেয়েছি, তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হননি। আন্দোলনের রক্তের মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রশাসন এসেছে। সেই রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার অর্থেই কথা বলেছিলাম। পরে বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেছি ও উপাচার্যের কাছে ক্ষমাও চেয়েছি।”
ছাত্র অধিকার পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক তামজিদ উদ্দিন বলেন, তাহসান হাবীব বর্তমানে সংগঠনের সঙ্গে নেই। তিনি অন্য একটি সংগঠনের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় সংগঠন থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগের পর চবি শিক্ষার্থীরা তৎকালীন প্রশাসনের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলন শুরু করেন। ওইদিনই উপাচার্য, দুই সহ-উপাচার্য, প্রক্টরিয়াল বডির ১০ সদস্য, ছাত্র উপদেষ্টা, পরিবহন প্রশাসকসহ ১৪টি হলের প্রাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে নতুন উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার কথা সিনেটের মাধ্যমে। তবে সাম্প্রতিক সময়সহ বিগত কয়েক মেয়াদে সেই বিধান উপেক্ষা করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—এমন অভিযোগ রয়েছে।