তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের খ্যাতনামা হাইয়া সোফিয়া জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে এবং ৮৬ বছর পর সেখানে প্রথমবারের মতো জুম্মার নামাজ পড়া হয়েছে।
এর আগে গত ১০ই জুলাই এক তুর্কী আদালত সাবেক এই গির্জাকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়নি বলে রায় দেয় এবং এর পরেই তুরস্কের ইসলামপন্থী সরকার একে মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের পক্ষে আদেশ জারি করে।
দেড় হাজার বছরের পুরনো হাইয়া সোফিয়া এক সময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থোডক্স গির্জা, পরে তা পরিণত হয় মসজিদে, তারও পর একে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।
বিশ্বের নানা দেশ থেকে এই ভবনটিকে মসজিদে রূপান্তরের সরকারি সিদ্ধান্তের নিন্দা করা হয়েছে।আজ শুক্রবার প্রথম জুম্মার নামাজের আগে শত শত মানুষ সেখানে জড়ো হন।
তুরস্কের ধর্মমন্ত্রী বলছেন, হাইয়া সোফিয়া মসজিদের ভেতরে এক হাজার মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারবেন।কিন্তু এর আগেই হাজার হাজার মানুষ মসজিদটির আশেপাশে জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য বসে পড়েন।
প্রথম দিনের জামাতে মসজিদের ভেতরে মুসল্লিদের সাথে সামিল হন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইপ এরদোয়ান।
তুর্কী ধর্মমন্ত্রী আলী এরবাস জানিয়েছেন, নতুন মসজিদের জন্য তিন জন ইমামকে নিয়োগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন মেহমেত বয়নুকালিন ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী আইন বিভাগের অধ্যাপক।
বৃহস্পতিবার টেলিভিশনে এক ভাষণে ইস্তাম্বুলের গভর্নর আলী এরলিকায়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলার স্বার্থে জুম্মার নামাজের মুসল্লিদের ‘ফেসমাস্ক, জায়নামাজ, ধৈর্য এবং সহানুভূতি’ নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করার পরামর্শ দেন।সাহায্যের জন্য মসজিদ ও তার আশেপাশে স্বাস্থ্য কর্মীরা মোতায়েন থাকবেন বলে তিনি জানান।
তুরস্কের এক আদালতের রায়ের পর ইস্তাম্বুলের খ্যাতনামা হাইয়া সোফিয়ায় আজান দেয়া হয়েছে
এর আগে সাবেক এই গির্জাকে জাদুঘরে পরিণত করা ঠিক ছিল না বলে রায় দিয়েছে তুর্কী আদালত। এর পরেই তুরস্কের ইসলামপন্থী সরকারের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইপ এরদোয়ান এটিকে মসজিদ বানানোর এক বিতর্কিত আদেশে সই করেছেন।
দেড় হাজার বছরের পুরনো হাইয়া সোফিয়া এক সময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা, পরে তা পরিণত হয় মসজিদে, তারও পর একে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে।
টুইটারে এক পোস্টে মি. এরদোয়ান জানান, হাইয়া সোফিয়ার সম্পত্তি ‘দিয়ামাত’ বা তুর্কী ধর্মীয় বিষয়ক দফতরের হাতে সোপর্দ করা হবে।এরপরই হাইয়া সোফিয়াতে প্রথমবারের মত আজান দেয়া হয়।সরকারের কট্টরপন্থী সমর্থক ‘হাবার টিভি’সহ অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলে এই দৃশ্য সম্প্রচার করা হয়।
হাইয়া সোফিয়ার ইতিহাস:
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা ও তাদের প্রভাবিত মিডিয়াগুলোতে বর্তমানে একটি প্রপাগান্ড খুব জোরে-সোরে চলছে, বলা হচ্ছে, তিনি নাকি হায়া সোফিয়া জাদুঘরকে মসজিদে রূপান্তর করেছেন।
জানা যায়, ৫’শ ৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন শাসনামলে প্রথম জাস্টিনিয়ানের নির্দেশে নির্মাণ কাজ শেষ হয় ’আয়া সোফিয়া’র’। স্থাপত্যকলার ইতিহাসে অন্যমাত্রা যোগ করেছে আয়া সোফিয়া। আর এই স্থাপত্য সোফিয়া সম্পর্কে অনেকেরেই রয়েছে অজানা। এখানে প্রবেশ করতেই এর কারুকাজ যে কারোরই চোখ জুড়াবে।
স্থাপনাটি খ্রিস্টান এবং মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষের কাছেই মর্যাদার বস্তু। ইতিহাসের পালাবদলের সাথে বদলেছে এর পরিচয় এবং ব্যবহার। বানানো হয়েছিল বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের উপাসনালয়। কালের বিবর্তনে ব্যবহৃত হয়েছে গ্রিক সনাতন খ্রিস্টানদের ক্যাথেড্রাল, রোমান ক্যাথলিকদের ক্যাথেড্রাল এবং মুসলিমদের মসজিদ হিসেবে। এখানে ছিল অর্থডক্স চার্চের প্রধানের অবস্থান। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো এখানেই।
আয়া সোফিয়ার মার্বেলের রঙিন যে নঁকশা রয়েছে, গির্জার সেই মূল অংশে দাঁড়িয়েই মুকুট পরতেন নতুন বাইজেন্টাইন সম্রাটরা। ৯’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল ’আয়া সোফিয়া’।
১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল এর পতনের পর অটোমান বা ওসমানি সাম্রাজ্যের তৎকালীন মুসলিম শাসক ফতেহ সুলতান মুহাম্মদ নিজ অর্থায়নে এটি খ্রীশ্চানদের থেকে ক্রয় করে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। পরে সুলতান হায়া সোফিয়াকে একটি ওয়াকফ সম্পত্তিতে রূপান্তর করেন এবং নিজের নামে ফাউন্ডেশন গঠন করে তার ওপর আয়া সোফিয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন। এরপর দীর্ঘ ৪৮২ বছর এটি মসজিদ হিসেবেই সমহিমায় বিরাজ করছিল।
১৯২৩ সালে কামাল পাশা তুরস্ক কেন্দ্রিক ওসমানি খেলাফতের বিলুপ্ত ঘোষণা করে সেকুলার শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেও তার শাসনামলেও এটি দীর্ঘ আট বছর মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছিল। জনরোষের ভয়ে ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই তিনি মসজিদটিকে বন্ধ করতে বা জাদুঘরে রূপান্তরিত করতে সাহস পাননি। এজন্য তাকে দীর্ঘ আট বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৩৫ সালে এটি জাদুঘরে রূপান্তর করার আগে তৎকালীন সরকার ৪ বছর পর্যন্ত মসজিদটিকে বন্ধ করে রেখেছিল।
তবে এটা ঠিক, ওসমানি খেলাফত প্রতিষ্ঠার আগে এটি কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টান ক্যাথেড্রাল হিসাবে নির্মিত হয় ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীতে ’নিকা দাঙ্গায়’ এটি ধ্বংস হয়েছিল। ১২০৪ সালে, এটি চতুর্থ ক্রুসেডারদের দ্বারা লাতিন সাম্রাজ্যের অধীনে রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। ১২৬১ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ফিরে আসার পরে পূর্ব অর্থোডক্স চার্চে পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল।
তাই ১৯৩৫ সালে মসজিদটিকে গীর্জায় রূপান্তরের দাবি উঠলেও যেহেতু মুসলিম শাসক ফতেহ সুলতান মুহাম্মদ নিজ অর্থায়নে এটি খ্রীশ্চানদের থেকে ক্রয় করেছিলেন তাই মসজিদটিকে গীর্জায় রূপান্তরের দাবি ধোপে টেকেনি। কিন্তু তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ঐতিহাসিক এই মসজিদটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। অবশেষে তুরস্কের আধুনিক সুলতান এরদোয়ান আবার হায়া মসজিদকে তার স্বমহিমায় নিয়ে গিয়ে তার পূর্বসুরির কলঙ্ক কিছুটা হলেও মোচন করতে সক্ষম হন।