সৌদি আরবসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার কারণ পেট্রো ডলার। এটা আমরা সবাই জানি। পেট্রো ডলার যেমন মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া, আবার সেই পেট্রো ডলারের সিংহভাগ খরচও হয় মানুষের জীবন বিধ্বংসী মিসাইল আর যুদ্ধাস্ত্রের পেছনে। বাংলাদেশে তেলের খনি নেই, কিন্তু তেলবাজের খনি আছে সেটা অনেকেই বলে থাকেন। তবে ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে ডলার আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ফেসবুক এবং ইউটিউবে ডলার ইনকামের অনুমোদন পাওয়ার পর এই জগতের অবস্থা বলতে গেলে ঠিক মধ্যপ্রাচ্যের মতো হয়েছে। সেখানে যেমন পেট্রো ডলারের সিংহভাগ মানুষের জীবন বিনাশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, আর এখানে অধিকাংশ কন্টেন্ট হয় উস্কানিমূলক। কারণ, অস্বাভাবিক কন্টেন্ট না দিলে মানুষ সেসব ভিডিও বা পোস্ট দেখবে না। এসব কন্টেন্টের কারণে সমাজে অস্থিরতা হয় হোক, তবুও লাখ লাখ ভিউ’র মাধ্যমে ডলার তাদের চাই। তবে গণহারে সবাই যে এমন করছে সেটা অবশ্য না, কিন্তু অস্থিরতার ক্ষেত্র তৈরি করে হলেও ডলার ইনকাম আর সস্তা জনপ্রিয়তার পথে হাঁটছে অনেকেই। এই প্রবণতা ক্রমেই বিধ্বংসী হয়ে উঠছে।
সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ইউটিউবে ঢুঁ মারলেই এখন হোমপেজ সাম্প্রদায়িক ভিডিওতে সয়লাব হয়ে যায়। অথচ কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল না। গ্রাম্য ওয়াজ মাহফিলে যেমন ধর্মীয় আলোচনার নামে বক্তা নামক কথিত পণ্ডিতরা বিদ্বেষ ছড়ান, ঠিক তেমনই অন্য পক্ষও তাদের আক্রমণ করেন একইভাবে।আবার এই তালিকায় বিদেশে পলাতক কিছু কথিত সাংবাদিকও যোগ দিয়েছে। মাহফিলের বক্তারা যতোটা সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে না পারেন, এর চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছেন তারা। ইসকন নামক একটি সংগঠনের নামে ছড়ানো অপপ্রচারে বিশ্বাস করে ভোলায় সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ঠিক সেই অপপ্রচার বিশ্বাস করে সেখানে ইসকনবিরোধী স্লোগানও দিতে দেখা গেছে অনেককে। অথচ এমন ভিডিও পরে দেখা গেছে যে, তারা জানেও না কেন তারা দলবেঁধে সেখানে যাচ্ছে।
ফেসবুক-ইউটিউবে ছড়ানো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অনেক সংখ্যাগরিষ্ঠ যখন অন্য ধর্মের বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিষয়ে হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করছেন, তখন সেই সাম্প্রদায়িক মানসিকতা বন্ধের উদ্যোগের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেখা গেল আরেক কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্ম। ঢাকা সিটি নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ পড়লো এমন দিনে, ঠিক যেই সময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন, কথা বলছেন এ বিষয়ে। এরপরও যেহেতু ভোটের তারিখ পরিবর্তন হলো না, তারা গেলেন আদালতে। সেখানেও তারা ঠাই পেলেন না। আদালত ওই রিট খারিজ করে দিলেন। এরপর আবার নির্বাচন কমিশন বললেন, ভোট আর পূজা একসঙ্গে হলে কোনো অসুবিধা হবে না!
এর মানে হচ্ছে, কমিশন আসলে ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি এ কারণে যে, কমিশন যদি না জেনেই এমনটা করতো, তাহলে জানার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করতো। নির্বাচন কমিশন তারিখ পরিবর্তন করলে কেউ সেখানে তাদের বলতে পারবে না, তোমরা কেন এমনটা করেছা? সংবিধান এমন কথাই বলছে। নির্বাচন কমিশন সংবিধানের পথে কতোটা চলছে, সেটা যদিও ইতিহাস-ই ভালো বলতে পারবে।
রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ নির্বাচন কমিশনের এমন গোয়ার্তুমির কারণে সরাসরি ভুক্তভোগী হলেও দেশব্যাপী কোটি সনাতন ধর্মাবলম্বীর হৃদয়ক্ষরণ হবে। নির্বাচন কমিশনের কাছে এসব অনুভূতির দাম না থাকলেও ডাকসু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ নানা মহলের উদ্বেগ এবং কঠোর অবস্থান আশার বিষয়। এমন অবস্থান পরিষ্কার করে দেয় যে, দেশটা এখনও ধর্মান্ধ আর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পুরোপুরি শিকার হয়ে যায়নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং অবস্থান নেয়ার মতো লোক এখনও রয়েছে।
তবে যতো কথাই বলা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নির্বিঘ্নে তাদের ধর্মীয় আয়োজন পালন করতে পারবেন না, এটাই মূল কথা। নির্বাচন কমিশন এখনও তাদের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করতে পারেন। তবে তারা সেটা করবেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ডলারের জন্য নির্মিত কন্টেন্টের দ্বারা প্রভাবিত হলে তারা ভোটের তারিখ পরিবর্তন করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। শঙ্কার বিষয় হলো, এসব মিথ্যাচার সফল হলে ডলারলোভীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।
নির্বাচন কমিশন চাইলে অবশ্যই পারে পূজার দিনে সিটি নির্বাচন না করতে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতির দিকে তাকিয়ে হলেও এমন দিনে ভোটের তারিখ পরিবর্তন করা উচিৎ। ডাকসু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং দেশের আপামর জনসাধারণের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা উচিৎ নির্বাচন কমিশনের। এর মাধ্যমে দেশে যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বাড়বে, তেমনই দিন শেষে দেশের সম্মান সমুন্নত হবে। নির্বাচন কমিশনের একটি সিদ্ধান্তই পারে এ বিষয়ে সকল সমালোচনার দ্বার বন্ধ করতে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)