পালমোনারি ফাইব্রোসিস কী?

ফুসফুস চিরকালের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য। এমন হাজার হাজার মানুষকে হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, ব্রিটেনে।

হাসপাতালে সিটি স্ক্যানে দেখা গেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর তার দুটি ফুসফুসের ওপরই একটা সাদা কুয়াশার আস্তরণ তৈরি হয়েছে- অনেকটা ভাঙা কাঁচের মত দেখতে। চিকিৎসকরা বলছেন এটা করোনাভাইরাস আক্রমণের একটা বৈশিষ্ট্য।

করোনাভাইরাসে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হলে শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা যখন অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এর ফলে প্রচুর শ্লেষ্মা, জলীয় পদার্থ এবং কোষ তৈরি হয়, যা ফুসফুসে যে বাতাস চলাচলের থলিগুলো আছে যাকে অ্যালভিওলি বলা হয়, সেগুলোকে ভর্তি করে ফেলে। এটা যখন হয়, তখন নিউমোনিয়া দেখা দেয় এবং সাহায্য ছাড়া মানুষের পক্ষে নিঃশ্বাস নেয়া সম্ভব হয় না।

আক্রান্ত হবার ছয় সপ্তাহ পর নেয়া মি. ম্যাকহিউয়ের এক্স-রে-তে দেখা গেছে তার ফুসফুসের ওপর একটা সাদা ছায়ার মত স্তর তৈরি হয়েছে যেটাকে ডাক্তাররা বলছেন পালমোনারি ফাইব্রোসিস বা ফুসফুসে ক্ষত সৃষ্টির প্রাথমিক লক্ষণ।

ব্রিটিশ সোসাইটি অফ থোরাসিক ইমেজিংএর একজন সদস্য এবং রয়াল কলেজ অফ রেডিওলজিস্টের উপদেষ্টা ড. স্যাম হেয়ার বলছেন, “সাধারণত এধরনের ভাইরাস সংক্রমণের পর ছয় সপ্তাহ হয়ে গেলে ফুসফুসের অবস্থা আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবার কথা- অন্তত চিকিৎসকরা সেটাই আশা করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা হয়নি এবং সেজন্যই এটা উদ্বেগের কারণ।”

পালমোনারি ফাইব্রোসিস

কোভিড আক্রান্ত হবার আগে সুস্থ ফুসফুসের ছবি

পালমোনারি ফাইব্রোসিস একধরণের রোগ যেখানে ফুসফুসের নরম অংশগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ১)এতে ফুসফুসের কলাগুলো (টিস্যু) মোটা ও শক্ত হয়ে যায়, ফলে ফুসফুসে বাতাসের থলিগুলো ঠিকমত কাজ করতে পারে না। ২)কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে এর ফলে নিঃশ্বাস নেয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে এবং ক্লান্তিবোধ দেখা দেয়। শুধু তাই নয় ভবিষ্যতে অন্য নানা ধরনের ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ৩)এই রোগ সারে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা আরও মারাত্মক রূপ নিতে পারে অর্থাৎ দিনে দিনে এই রোগীর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ৪)কোভিড-১৯এর ফলে ফুসফুসের যে ক্ষতি হয়, তা নিয়ে গবেষণার কাজ এখনও খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।

ধারণা করা হচ্ছে যাদের হালকা উপসর্গ হয়, তাদের ক্ষেত্রে স্থায়ী ক্ষতি হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে, বিশেষ করে যাদের নিবিড় পরিচর্যায় রাখার দরকার হচ্ছে বা যাদের সংক্রমণ খুবই গুরুতর পর্যায়ে হচ্ছে, তাদের ভবিষ্যতে জটিলতা তৈরি হবার আশংকা আছে।

মার্চ মাসে চীনে চালানো এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, সেরে ওঠা ৭০ জন করোনা রোগীর মধ্যে ৬৬জনেরই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরেও ফুসফুসের নানা সমস্যা রয়ে গেছে।

ব্রিটেনের রেডিওলজিস্টরা সেরে ওঠা রোগীদের প্রাথমিক স্ক্যান পরীক্ষার ভিত্তিতে বলছেন যারা কোভিডে বেশি অসুস্থ হচ্ছে তাদের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির আশংকা বেশি।

“সেরে ওঠার ছয় সপ্তাহ পর যেসব রোগীর ফুসফুসের স্ক্যান আমরা দেখেছি, তার থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ রোগীর ফুসফুসে ক্ষত তৈরির লক্ষণ পরিষ্কার,” বলছেন ড. হেয়ার।

অন্য রেডিওলজিস্টরাও বিবিসিকে একই উদ্বেগের কথা বলেছেন, তারাও একই প্যাটার্ন দেখছেন।

এর আগে যে দুটো করোনাভাইরাস সংক্রমণ আমরা দেখেছি- সার্স এবং মার্স – তাতে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ রোগীর পালমোনারি ফাইব্রোসিস ধরনের কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়েছিল।

তবে সার্স ও মার্স তুলনামূলকভাবে আরও সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এর জীবাণু সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। এবং এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ৮০ লাখের বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে।

“আমার মূল উদ্বেগটা হল কোভিড-১৯ বিশাল একটা জনসংখ্যাকে সংক্রমিত করেছে,” বলছেন ড. হেয়ার।

“এই ভাইরাস এত মানুষকে আক্রমণ করেছে, ফলে কত মানুষকে যে দীর্ঘমেয়াদে এই ভাইরাস পঙ্গু করে দিয়েছে তার সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বিশাল।”

ভবিষ্যৎ চিকিৎসা

কোভিড আক্রান্ত হবার পর ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসের ছবি

ফুসফুসের ফাইব্রোসিস বা ফুসফুসের দেয়াল মোটা হয়ে যাওয়া সারানো যায় না, কারণ ফুসফুসের কোষ একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা চিরস্থায়ী হয়। তবে নতুন ওষুধ দিয়ে এই ক্ষতির মাত্রা কমানো যেতে পারে। হয়ত তা কিছুটা বিলম্বিত বা আটকানোও সম্ভব হতে পারে, তবে তার জন্য এই সমস্যা সময়ে ধরা পড়তে হবে।

“সমস্যাটা কতটা গুরুতর তা বোঝা দরকার এবং জানা দরকার ঠিক কখন এটা আটকাতে ওষুধ দেয়া দরকার,” বলছেন ব্রিটেনের স্বাস্থ্য গবেষণা বিষয়ক জাতীয় ইন্সটিটিউটের গবেষক ও অধ্যাপক জিসলি জেনকিন্স।

“আমাদের জীবদ্দশায় এর আগে একই সাথে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ফুসফুস এধরনের আঘাতের মুখোমুখি হয়নি।”

কাজেই করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠা রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মূল্যায়ন করা এবং তাদের এই ক্ষতি কমাতে সাহায্য করা যায় কিনা সেটাই এখন গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের সামনে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ।

তথ্য:বিবিসি