সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে, আর নয়। মোট কথা এ কমিশন নির্বাচন নিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। দেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষায় উদ্যোগী হতে হয় কমিশনকে। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন সুষ্ঠু করার সব ক্ষমতা তাদের আছে।
বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
ইসির তথ্যানুযায়ী, পাঁচ ধাপের পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ১৪৪টি, বিএনপি ১১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩২টি পৌরসভায় জয়ী হয়েছেন। প্রথম ধাপের তফসিলের ২৪টি পৌরসভায় ইভিএমে ভোট হয় ২৮ ডিসেম্বর। ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের, তৃতীয় ধাপের ভোট হয় ৩০ জানুয়ারি ও চতুর্থ ধাপের ভোটগ্রহণ হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। আর পঞ্চম ধাপে ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ হয়।
প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ১৮ জন, বিএনপির দুইজন এবং তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে বিজয়ী হন। দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৫ জন, বিএনপির চারজন, জাতীয় পার্টির একজন, জাসদের একজন ও আটজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মেয়র পদে বিজয়ী হন। তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৬ জন, বিএনপির তিনজন ও ১৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। চতুর্থ ধাপে আওয়ামী লীগের ৪৬ জন, বিএনপির একজন ও পাঁচজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। পঞ্চম ধাপে আওয়ামী লীগের ২৯ জন, বিএনপির একজন ও দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন।
এ নির্বাচন নিয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আচরণে পক্ষপাত ছিল। একইসঙ্গে যারা নির্বাচনে অপরাধ করেছে, নির্বাচনে বিভিন্ন রকম কারচুপি ও নির্বাচকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে, তাদের কারও বিরুদ্ধেই ইসি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কয়েকটি নিলেও অতটা উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নয়। এটা পুরো নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক, এর পরিণতি চরম অমঙ্গলকর হবে। আমি মনে করি, এই নির্বাচন কমিশন আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।’
সম্প্রতি জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার চট্টগ্রামের রাউজানে মেয়রসহ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১২ জন নির্বাচিত হওয়ায় ইসির সমালোচনা করেছেন। পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অভিযোগ করেন, মাহবুব তালুকদার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, ‘এটা শুধু রাউজানে নয়, আরও অনেক জায়গায় এরকম আছে। আমিও বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখলাম মাহবুব তালুকদারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন। এছাড়া অনেক নির্বাচন নিয়েই সিইসিসহ ইসি দায়সারা বক্তব্য দিয়েছে।’
পঞ্চম ধাপের পৌর নির্বাচন শেষে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত বড় দল বিএনপি বর্তমান কমিশনের অধীনে নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে দ্বিতীয় দফায় ইমেজ সংকটে পড়তে যাচ্ছে ইসি। তবে ভোটে সব দলের অংশগ্রহণ চায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে আগামী ইউপি নির্বাচন থেকে সব ধরনের স্থানীয় নির্বাচনে দলীয়ভাবে আর অংশগ্রহণ করবে না বিএনপি। এর আগে বর্তমান কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। পরে প্রথম দফায় অভিযোগ দেখিয়ে সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তারপর পৌরসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। কিন্তু বর্তমান ইসির ভোট ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা জানিয়ে আগামীতে এই কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচন করতে চায় না দেশের অন্যতম বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলটি। শুধু বিএনপি নয়, আরও কিছু নিবন্ধিত দল এ কমিশনের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে জানিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৮ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগামী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দলগতভাবে বিএনপি অংশ নেবে না। আগামীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা কাউকে মনোনয়ন দেব না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন ও সব পৌরসভা নির্বাচনে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে চরম ব্যর্থতা নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিন্দা ও ধিক্কার জানানো হয়েছে।
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না- এ বক্তব্যের বিষয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, ‘তারা অংশগ্রহণ করেও তো কিছু হচ্ছে না। কারণ গত দুটি ধাপে যে নির্বাচন হলো তাতে তো বিএনপি পেল মাত্র কয়েকটি করে সিট। বিশেষ করে কয়েকটা মাত্র মেয়র পদ পেল, এইটা কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এগুলো তো নির্বাচন নয়, এগুলো প্রহসন। আমার তো মনে হয়, এতে কিছু আসে যায় না। ক্ষমতাসীন দলের যারা এখন মনোনয়ন পাবে, তারাই জিতে আসবে।’
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, ‘এইটা তো তাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমি মনে করি, এতে কিছু আসে যায় না। বর্তমানে নির্বাচন যেই পর্যায়ে পৌঁছেছে, নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। কে মাঠে আসলো, কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল বা কে করল না, সেটা কিছু না। কারণ যা হওয়ার তাই হবে। চট্টগ্রামে তারা (বিএনপি) ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৫ সালে যে নির্বাচন হয়েছে, সেই সময় কেন্দ্রও দখল হয়েছিল। ২২টা কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছিল বিএনপি। এটা তো পাগলেও বিশ্বাস করবে না।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। এখন একটা বড় দল যদি না আসে, তাহলে তো এটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। নির্বাচন কমিশন বলতে পারে, তোমরা আলাপ-আলোচনা কর, তারপর আমরা সবাই বসে নির্বাচন সুষ্ঠু করার পথ বের করব। বর্তমান কমিশন এইটা তো করবে না। অথচ এটাই করা উচিত। আর নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আছে। তারা নির্বাচন বাতিল করে দিতে পারে, বন্ধ করে দিতে পারে। রাতকে দিন করা ছাড়া, দিনকে রাত করা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশন সবকিছু করতে পারে। সব ক্ষমতা তাদের কাছে আছে।’
উল্লেখ্য, প্রথম ধাপে ৩২৩টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন হবে আগামী ১১ এপ্রিল। এ নির্বাচনও হবে কয়েক ধাপে। তবে এবার বিএনপি ইউপি নির্বাচনে না এলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার হিড়িক দেখা যেতে পারে। এর আগে ২০১৬ সালে ছয় ধাপে আওয়ামী লীগের ২১২ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে বিনা ভোটে জয়ী হন।