দেশের প্রথম নারী মেজর জেনারেল সুসানে গীতি। জন্মের পর নানা তার নাম রেখেছিলেন সাউসান ই গীতি। ফার্সি শব্দের এই নামের অর্থ ‘পৃথিবীর ফুল’। শিক্ষাবোর্ডের কারিশমায় নাম হয়ে যায় সুসানি গিতি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে তার সংগ্রাম ও সফলতার গল্প।
আপনি বাংলাদেশের প্রথম নারী মেজর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কেমন লাগছে?
স্বাভাবিকভাবে খুবই সুন্দর লাগছে। নতুন কিছু শুরু করার মধ্যেই অন্যরকম আনন্দ থাকে। সেক্ষেত্রে আমাকে দিয়ে শুরু হয়েছে। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ তালার কাছে কৃতজ্ঞ। নারী ক্ষমতায়নের জন্য যিনি কাজ করছেন, প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। সমগ্র দেশের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ।
কাজের ক্ষেত্রে আপনি নিজেকে নারী হিসেবে দেখেছেন নাকি ব্যক্তি হিসেবে দেখেছেন?
কাজের ক্ষেত্রে আমি তো আমার কাজটাকেই প্রাধান্য দিবো। এর মধ্যে নারী-পুরুষের কোনো বিভেদ আনতে চাইনি। যেটা আমার কাজ, সেটাই আমি করেছি।
আমাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে এই বিভেদটাকে প্রায় সামনে আসতে দেখি। আপনার জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল কিনা?
সেনাবাহিনীতে সিস্টেমটাই অন্যরকম। যে দায়িত্ব আমাকে অর্পণ করা হয় সেই দায়িত্ব আমি পালন করতে বাধ্য এবং সেটা আমরা সুচারুভাবে পালন করে থাকি।
দেশের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এটাকে কিভাবে দেখছেন?
এটা বিরাট পজিটিভ দিক। সামগ্রিকভাবে কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে ছিলাম। কিছুদিন ধরে নারীর ক্ষমতায়ন চলছে। এতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অবদান অনেক। আমাদের দেশ আরও এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। আরও উন্নত হবে। কারণ, একটা শিক্ষিত মা শিক্ষিত সমাজ উপহার দিবে। যা দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
আপনি মেডিকেল কোর থেকে মেজর জেনারেল পদ অর্জন করেছেন। অন্যান্য কোর থেকে নারীদের এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে আপনার কী ভূমিকা থাকবে?
অবশ্যই ভূমিকা থাকবে। ওরা নতুন আসছে। এবারই প্রথম লেফটেনেন্ট কর্নেল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ওরা সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক নিয়মেই এগিয়ে যাবে।
আপনার সেনাবাহিনীতে আসার গল্পটা যদি বলতেন?
সেনাবাহিনীর নিয়ম, ডিসিপ্লিন, কর্তব্যবোধ আমাকে এ পথে আসতে উৎসাহ যুগিয়েছে। আমাদের মেডিকেল কলেজের একজন ডিরেক্টর ছিলেন সেনাবাহিনীর। স্যার খুব ডিসিপ্লিনড ছিলেন। সুন্দরভাবে কলেজ পরিচালনা করতেন। আমাদের দেখে ভালো লেগেছিল। তার থেকেই অনুপ্রেরণা পাওয়া।
এতদূর আসার পথে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে?
অবশ্যই কিছু চ্যালেঞ্জ তো থাকেই। আমাদের কাজের ক্ষেত্রে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আসতে হয়।
আপনি তো বিভিন্ন দেশের মেয়েদের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমাদের দেশের মেয়েরা অন্যান্য দেশের মেয়েদের তুলনায় পিছিয়ে আছে?
বর্তমানে কিন্তু আমরা অনেক এগিয়ে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার থেকে শুরু করে বড় বড় পদে মেয়েরা কাজ করছে। অনেক মেয়ে সাংবাদিকতা করছে। অ্যাডমিন ক্যাডারে অনেক মেয়ে কাজ করছে। বিচারকার্যে নারীরা কাজ করছে। আমাদের মেয়েরা বহির্বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
সেক্ষেত্রে কি আমরা দেখতে পারি যে আমাদের সেনাপ্রধান একজন নারী?
হতেও পারে। আমাদের অন্যান্য কোরেও তো মেয়েরা আসছে। যোগ্যতার বলে তারা এমন পদে যেতেই পারে।
এই মুহূর্তে আপনার প্রধান চ্যালেঞ্জ কী বলে মনে করছেন?
মানুষ যত উপরে উঠবে তত দায়িত্ব বাড়বে। আমার কাছে এখন পেশাগত জ্ঞান দিয়ে মানুষের সেবাটাকে আরও উন্নতি করা।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের নারীরা অংশ নিচ্ছে। তারা কেমন করছে?
খুবই ভালো করছে। অনেক মহিলা এখন মিশনে যাচ্ছে। এটা খুবই ভালো দিক।
আপনি তো শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করেছেন। ওখানে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা বলবেন আমাদের?
ফিমেল হিসেবে আমরাই প্রথম গিয়েছিলাম। ওরা আমাদের খুব পছন্দ করতো। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে ফ্রি চিকিৎসা দিতাম। ওরা আমাদের এত পছন্দ করতো যে আমাদের কাছে এসে বাংলা শিখতো। বাংলাদেশ তাদের খুব পছন্দের।
সেনাবাহিনীতে আসতে আগ্রহী নতুন প্রজন্মের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
নতুন প্রজন্মের কাছে আমার পরামর্শ বি ডেডিকেটেড টু ইয়োর সার্ভিস।
নিজেকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন আর বাংলাদেশকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন?
বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাক। বিশেষ করে আমি একজন শহীদ পরিবারের মেয়ে। আমি চাই আমার বাবার রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি আরও উন্নতি চাই এদেশের।
নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
আমাকে যেন আদর্শ ভেবে অন্যরা এগিয়ে আসে এটা আমি চাই।
আমরা জানি আপনার হাজবেন্ড একজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল। আপনার এই অবস্থানে আসতে উনার অবদান কতটুকু?
অবশ্যই একটা ফ্যামিলি লাইফে দু’জন দু’জনার ভালো না চাইলে কিন্তু সেটা এগিয়ে যায় না। আমার বাচ্চাদেরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ফলে সবারই অবদান আছে।
আপনার ছেলে-মেয়েরা কোথায় কী করছে?
আমার তিন ছেলে-মেয়ে। এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় দুই ছেলে-মেয়ে ডক্টর। ছোটমেয়ে পড়ছে। এইচএসসিতে।
বাংলাদেশের মেয়েরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। তাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন? শৈশবে কেমন স্বপ্ন দেখতেন? টার্গেট কী ছিলো এসব নিয়ে…
এখনকার মেয়েরা কিন্তু বড় বড় স্বপ্ন দেখছে। আমার টার্গেট ছিল মেডিকেলে পড়ার। তবে সেনাবাহিনীতে আসার টার্গেট পরে হয়েছে। সেনাবাহিনীর ডিসিপ্লিন আমাদের আগ্রহী করে তুলেছিল।
আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা জানতে চাই
আর্মিতে যোগ দেওয়াটাই আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। এরপর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হলাম। এটাই সবথেকে বেশি স্মরণীয় ঘটনা আমার জন্য।
যেমনটা বলছিলেন, আপনি শহীদ পরিবারের সন্তান। এজন্য বাড়তি কোনো দায়িত্ববোধ কাজ করে কি?
আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। উনার নাম শহীদ খলিলুর রহমান। উনি রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে মারা যান বাবা। আমরা তার লাশটা পর্যন্ত পাইনি। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের জন্য আমাদের পরিবারের অনুভূতিটা অন্যরকম।
আপনার শৈশব ও পড়াশুনা কোথায়?
আমার পড়াশুনা ও বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে। পিএন গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি, রাজশাহী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি।
আপনার এ অবস্থানে পৌঁছানোতে সব থেকে বেশি অবদান কার?
অবশ্যই আমার মায়ের। আমার নানীও খুব সাহায্য করেছেন।
সূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন