ঢাকার পল্লবী থানার ভেতরে বিস্ফোরণ

বুধবার ভোর পাঁচটা নাগাদ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পল্লবী থানার ভেতরে বিস্ফোরণের ঘটনায় চার জন পুলিশসহ মোট পাঁচ জন আহত হয়েছেন।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় যে একটি আইইডি-র (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণ ঘটার ফলে সেখানে পুলিশ সদস্যদের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় জানান, থানার মধ্যে একটি ছোট বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে।

তিনি বলেন ”পল্লবী থানায় কোন আইইডি’র বিস্ফোরণ ঘটেনি, তবে সেখানে অপরাধীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা যে বিস্ফোরক ছিল, তার বিস্ফোরণ ঘটায় পুলিশ সদস্যদের আহত হওয়া ঘটনা ঘটে।” তিনি আরও বলেন, এটি কোন জঙ্গি তৎপরতা নয় বলেই তারা মনে করছেন।

এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার ওয়ালিদ হোসেন বলেছেন, ”গোপন সূত্রের খবরে গতকাল তিনজন ভাড়াটে খুনিকে গ্রেপ্তার করেছিল পল্লবী থানার পুলিশ। তাদের কাছ থেকে দুইটি পিস্তল আর জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়, তার মধ্যে ওয়েট মেশিনের (ওজন পরিমাপ করার যন্ত্র) মতো দেখতে একটি বস্তু ছিল।”

আজ সকাল সাতটার দিকে সেই ওয়েট মেশিনের মতো বস্তুটির বিস্ফোরণ ঘটলে চার জন পুলিশ সদস্য ও একজন সাধারণ নাগরিক আহত হয়। তাদের মধ্যে ওসি তদন্ত, একজন এসআই ও দুইজন পিএসআই রয়েছেন।”

এই ঘটনার পর পুলিশের বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তারা পল্লবী থানায় এসে তদন্ত শুরু করেছেন। আটককৃত ব্যক্তিদের এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।ধারণা করা হচ্ছে, এই ওজন মাপা যন্ত্রের ভেতর বোমা স্থাপন করে রাখা হয়েছিল।

ঘটনাস্থল থেকে একজন সাংবাদিক বলছেন, সকাল ১১টার দিকে থানার ভেতরের একটি কক্ষে আরও দুইটি বোমার নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

এমন সময়ে এ ঘটনা ঘটলো যখন সম্প্রতি দেশ জুড়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। সেখানে পুলিশকে টার্গেট করে বা পুলিশ স্থাপনায় হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

শনিবার পল্টন এলাকা থেকে একটি বোমা সদৃশ বস্তু উদ্ধার করা হয়। তার আগের দিন শুক্রবার পল্টনে একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।

এদিকে গত ২৯শে এপ্রিল ঢাকার গুলিস্তানে একটি পুলিশ বক্সে হামলা হয়েছিলো। সেই হামলার দায়ও স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী।মালিবাগে যে গাড়িতে বিস্ফোরণটি ঘটেছে সেটি পুলিশের বিশেষ শাখা এসবি’র একটি পিক-আপ ভ্যান।

যেখানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তার পাশেই রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ও এসবির প্রধান কার্যালয়।

পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, “পুলিশই নির্দিষ্ট করে এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল কিনা সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।” তবে তার ভাষায়, একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করার অপচেষ্টা এটি।

তিনি বলছেন, “আমার কাছে মনে হচ্ছে জনমনে ভীতি প্রদর্শন করে, পুলিশের গাড়ি অথবা পুলিশ বক্সে হামলা করে পুলিশের নৈতিকতা বা মোরালকে ডাউন করে দেয়ার চেষ্টা এটি।”

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-দুই প্রেক্ষাপটেই বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে জঙ্গি গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড দমনে বেশ কঠোর অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।

মি. আসাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, জঙ্গিবাদের একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক প্রভাব আছে এবং বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক প্রভাবের বাইরে নয়।

২০১৬ সাল থেকে সফল অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদকে দমন করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন, “একটা অপচেষ্টা আছে। একটা অপ-তৎপরতা আমরা লক্ষ করছি।”

তিনি নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা এবং শ্রীলংকার গির্জায় হামলা এই দুটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন যে, মালিবাগ ও গুলিস্তানের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থার সাথে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।তবে তিনি এও বলেছেন দেশের ভেতরের কোন শক্তি দেশের বাইরে বসে কিছু করছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পুলিশ যে কারনে লক্ষ্যবস্তু?

সুইডেন ভিত্তিক জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ তাসনিম খলিল বলছেন, তার মনে হয়েছে নতুন একটি গোষ্ঠী এই হামলা চালিয়েছে। বাংলাদেশে আগে যাদের কর্মকাণ্ড ছিল না এমন কোন গোষ্ঠী পুলিশের উপরে হামলার জন্য দায়ী বলে তার মনে হচ্ছে।

তিনি বলছেন হামলার দায় স্বীকার করার ধরণে কিছুটা পার্থক্য তিনি দেখতে পাচ্ছেন।

তার বিশ্লেষণ হল, “তারা অফিসিয়ালি আইসিসের কাছ থেকে কোন স্টেটমেন্ট আসার আগেই বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেলে যেভাবে তারা এটি প্রচার করেছে এবং বিভিন্ন ছবি তারা শেয়ার করেছে – আইসিসের দায় স্বীকার করার যে চেইনটা আছে, আমার কাছে মনে হয় এই ঘটনার ক্ষেত্রে সেটি মেইনটেইন হয়নি। কিছু নতুন এলিমেন্ট এই ঘটনায় রয়েছে।”

বার্তা আদান প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রাম জঙ্গি গোষ্ঠীরা ব্যবহার করে থাকেন বলে নানা সময়ে শোনা গেছে। তিনি বলছেন, পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীকে যে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হবে সেটি মার্চ থেকেই খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলো আইসিসের একটি প্রকাশনার সূত্রে।

এর আগেও কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলার লক্ষবস্তু হয়েছে। ২০১৭ সালে মার্চেই দুটি হামলা হয়েছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বাইরে পুলিশের একটি চেক পোস্টের কাছে বোমা বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলো। যিনি নিহত হয়েছেন তিনি নিজেই সেই বোমা বহন করছিলেন বলে এটিকে সেসময় আত্মঘাতী হামলাও বলা হয়েছে। সেই সময় আইএস দাবি করেছে যে, তারা এই ‘হামলাটি’ চালিয়েছে।

আইএস পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট ‘আমাক’ থেকে এই দায় স্বীকার করা হয়েছিলো। একই মাসে র‍্যাবের একটি অস্থায়ী সদরদপ্তরের নির্মাণকাজ চলাকালীন এক যুবক তার সাথে বহন করা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

তাসনিম খলিল বলছেন, “বাংলাদেশে পুলিশ সম্পর্ক সাধারণ মানুষের একটা নেতিবাচক ধারনা আছে। পুলিশ খুব সহজ টার্গেট। তারা রাস্তাঘাটে অ্যাক্টিভ থাকেন। তাদের উপর হামলা করাটা সহজ।”

তিনি বলছেন, “জিহাদিরা পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীকে তারা যেভাবে দেখে, তারা তাদের একটা সেক্যুলার রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দেখে। তাদের জন্যে লোভনীয় টার্গেট পুলিশ। তারা আদর্শিক-ভাবে এটাকে একটা বড় অর্জন বলে মনে করে।”

পুলিশের বক্তব্য

এই হামলায় আইএসএর সম্পৃক্ততার বিষয় সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। তারা বলছে, হামলার বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে এবং আইএস’এর দায় স্বীকারের বিষয়টিও পুলিশের দৃষ্টিতে এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত ঘটনার সাথে আইএস’এর কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।