বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে করোনাভাইরাসের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে বিবৃতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। পৃথিবীর কয়েকশ কোটি মানুষকে সফলভাবে এই টিকা দেবার ব্যবস্থায় যে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সে ভাবনা তাদের অনেকের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে টিকা আসলে তা শুরুতে কীভাবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য পাওয়া সম্ভব, সেই বিষয়গুলো মূলত উঠে এসেছে কারিগরি কমিটির বিবৃতিতে।
যেসব প্রতিষ্ঠান বা দেশ টিকার ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে, টিকা বাজারে আসার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়া নিশ্চিত করতে তাদের সাথে এখনই যোগাযোগ করার সুপারিশ করেছে কমিটি।
পাশাপাশি টিকা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সিরিঞ্জ উৎপাদন বা কেনার প্রস্তুতি রাখা, টিকা পাওয়ার পর তা সংরক্ষণ, বিতরণের পরিকল্পনা ঠিক করে রাখা এবং টিকা পাওয়ার পর জনসংখ্যার কারা অগ্রাধিকার পাবে তা এখনই ঠিক করে রাখার আহ্বান জানানো হয় কমিটির সুপারিশে।
বিবৃতিতে বলা হয়, কয়েকটি সংস্থার টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি বাংলাদেশে হলে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তা প্রমাণের সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি টিকা সফল হিসেবে প্রমাণিত হলে তা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়ার সুযোগও থাকবে।
এদিকে বিশ্বব্যাপী সাতশ কোটির ওপর মানুষের কাছে এই টিকা কীভাবে পৌঁছে দেয়া যাবে সেটাও একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
ব্রিটেনে টিকা উৎপাদনের প্রধান কাজটি হচ্ছে অক্সফোর্ডশায়ার এলাকার সাবেক একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে হারওয়েল সায়েন্স ক্যাম্পাসে।
এটিকে যুক্তরাজ্যের টিকা প্রস্তুত ও উদ্ভাবন কেন্দ্র (ভ্যাকসিন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার- ভিএমআইসি) হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে। কোভিড-১৯এর কারণে এই কেন্দ্রের পরিকল্পনা কর্মসূচি আরও ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
“আগের সময়সূচি অনুযায়ী আমরা ২০২২এর শেষ নাগাদ ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। এখন আমরা ২০২১ সালে এটি অনলাইনে ছাড়তে পারব বলে আশা করছি,” ব্যাখ্যা করেছেন ভিএমআইসি-র প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ ডাচারস্।
মি. ডাচারস্ তার গরমের ছুটি বাতিল করে দিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন, কারণ তিনি জানেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন এই কেন্দ্র গণহারে উৎপাদনে সফল হবে। তিনি গবেষক দলের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখছেন।তিনি বলছেন এটা বিশাল একটা দায়িত্ব।”এধরনের সফল ও কার্যকর ভ্যাকসিন খুব দ্রুত এবং সঠিকভাবে উৎপাদন করার বিষয়টা শুধু ব্রিটেনের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” তিনি বলছেন।
একটা সময়ে পুরো মানব জাতির জন্য কোভিড-১৯ এর বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিনের কয়েক বিলিয়ন ডোজে উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। সেগুলোর উৎপাদন, সরবরাহ বা বিলিব্যবস্থা এবং তা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশকে।
ভ্যাকসিন বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট, যার নাম গ্যাভি, তারা দেশগুলোকে এখন থেকেই টিকা কর্মসূচি বা তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতার বিষয়টা খুব সহজ হবে না। কারণ বেশ কিছু ধনী দেশ ইতোমধ্যেই ওষুধ প্রস্তুতকারকদের সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে চুক্তি করে ফেলেছে, যাতে ম্যাজিক ফর্মূলা পাওয়া গেলেই তাদের সরবরাহ নিশ্চিত হয়ে যায়।
গ্যাভি-র প্রধান নির্বাহী সেথ বার্কলে বলছেন তিনি সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেটা হল তথাকথিত “ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ”।
“আমার মতে সব দেশকে এটা বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিবেচনা করতে হবে, এর একটা কারণ সেটাই হবে ন্যায়সঙ্গত, এছাড়াও এখানে স্বার্থের বিষয়টা জড়িয়ে আছে, সেটার উপরে উঠতে হবে,” তিনি বলছেন।
“আপনার প্রতিবেশি দেশগুলো যদি ভাইরাসের খনি হয়, সেখানে যদি প্রচুর ভাইরাস ঘোরাফেরা করে, তাহলে তো আপনি স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য, ভ্রমণ, মানুষের যাতায়াত এসব আবার শুরু করতে পারবেন না। এটা মাথায় রাখা খুবই প্রয়োজন। সবাই নিরাপদ না হলে আমিও নিরাপদ নই।”
উন্নয়নশীল দেশগুলোও যাতে সঠিক ভ্যাকসিন পেতে পারে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টাও মি. বার্কলেকে করতে হচ্ছে। তিনি বলছেন ভ্যাকসিন যখন বাজারে ছাড়া হবে তখন আনুষঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ আরও নানা বিষয় নিয়েও তাকে ভাবতে হচ্ছে, যেমন পৃথিবীতে যথেষ্ট কাঁচের ভায়াল বা টিকা রাখার শিশি আছে কিনা। কারণে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত উপযুক্ত কাঁচের উৎপাদনে সম্ভাব্য সংকটের কথাও খবরে এসেছে।
“আমরা এটা নিয়েও উদ্বেগে রয়েছি,” স্বীকার করেছেন মি. বার্কলে, “তাই আমরা দুশ’ কোটি টিকার ডোজের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত ভায়াল কিনে রেখেছি। আমরা ২০২১-এর মধ্যে এই পরিমাণ টিকা প্রস্তুত করে ফেলতে পারব বলে আশা রাখছি।”
কাঁচের ভায়াল নিয়ে সম্ভাব্য সংকটই একমাত্র সমস্যা নয়, ফ্রিজ নিয়েও সমস্যা রয়েছে। কারণ অধিকাংশ ভ্যাকসিনই নিচু তাপমাত্রায় মজুত রাখতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্তমানে ফ্রিজে ঔষধ মজুত রাখার যে সক্ষমতা আছে তা কীভাবে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে গ্যাভির মত সংস্থাগুলোকে পরামর্শ ও সাহায্য দিচ্ছেন ঠাণ্ডায় ঔষধ সামগ্রী মজুত রাখা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টোবি পিটার্স।
তিনি বলছেন: “শুধু ভ্যাকসিন মজুত রাখার জন্য ফ্রিজ থাকলেই হবে না, এই টিকা কার্যকর রাখতে সবসময় সেটার সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। যেমন টিকার চালান বিমানে তোলার জন্য যে পরিবহন ট্রলি ব্যবহার করা হবে তার তাপমাত্রা, স্থানীয় ঔষধ গুদামে সরবরাহ পৌঁছনর জন্য যে গাড়ি ব্যবহার করা হবে তার তাপমাত্রা, এরপর আছে পাড়ায় পাড়ায় সেগুলো সরবরাহের জন্য যে যানবাহন ব্যবহার করা হবে বা যে ব্যবস্থা নেয়া হবে, সেখানে সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা – সবকিছু সঠিক এবং নিখুঁতভাবে কাজ করতে হবে।”
বিশ্বের বড় বড় খাদ্য ও পানীয় সংস্থাগুলো যারা বিশ্বব্যাপী ব্যবসা করে, তারা তাদের পণ্য সরবরাহ চেইনে যে হিমঘর ব্যবস্থা ব্যবহার করে তা এই বিশাল প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করার জন্য ধার নেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন অধ্যাপক পিটার্স।
এই টিকা যখন বাজারে ছাড়া হবে তখন তার জটিল ব্যবস্থাপনার অংশ হিসাবে দেশগুলোকেও ভাবতে হবে জনগোষ্ঠীর কোন্ অংশকে তারা টিকা দেবার ব্যাপারে অগ্রাধিকা দেবে। এসব ভাবনা আগেভাগেই শুরু করতে হবে।
যুক্তরাজ্যের ওয়েলকম ট্রাস্টের ভ্যাকসিন বিভাগের প্রধান ড. চার্লি ওয়েলার বলছেন দেশগুলোকে বেশ কিছু প্রশ্ন খোলাখুলিভাবে সামনে আনতে হবে।
“এই টিকা কাদের বেশি প্রয়োজন? সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী কারা? কাদের সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে? কারণ এটা একেবারে স্পষ্ট যে প্রাথমিকভাবে টিকার চাহিদার তুলনায় সরবরাহের সম্ভাবনা থাকবে কম। কাজেই টিকাদান প্রক্রিয়ায় বাছাইয়ের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হবে আর সে কারণেই এসব প্রশ্নের উত্তর বিবেচনায় রাখা খুবই জরুরি।” এমনকী টিকা দেবার ব্যাপারটাও জটিল হবে।
যেমন, ব্রিটেন ভোটের সময় যে ভোটদান কেন্দ্রের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে, সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ব্রিটেন গণহারে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার কথা বিবেচনা করছে। কিন্তু একই মডেল পৃথিবীর অনেক দেশেই হয়ত কাজ করবে না। এই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে – অর্থাৎ গণ-টিকাদান কীভাবে হবে।
ড. ওয়েলার জোর দিয়ে বলছেন একটা শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এজন্য অপরিহার্য হবে। যে জনগোষ্ঠীকে প্রতিষেধক টিকা দেয়া হবে, তাদের এই টিকা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা স্বাস্থ্য কর্মীদের থাকতে হবে।
বিজ্ঞানীরা সবাই বলছেন কোন একটা ভ্যাকসিন অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে তাদের অনেকেই স্বীকার করছেন পৃথিবীর কয়েকশ কোটি মানুষকে সফলভাবে এই টিকা দেবার ব্যবস্থায় যে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সে ভাবনা তাদের অনেকের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।