বাজেটের ভারসাম্য ঠিক রাখতে ও ভর্তুকি সহনীয় পর্যায়ে রেখে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের (বাড়ানো) সুপারিশ করা হয়েছে ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ এবং ‘বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটি’র বৈঠকে।
বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বৈঠকে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। দুপুর ২টায় জুম বৈঠক শুরু হয়ে চলে চারটা পর্যন্ত। অর্থনীতি খাতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে আমদানি, রপ্তানি পরিস্থিতি, এডিপিসহ চলতি বাজেট বাস্তবায়ন হার নিয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়া ভর্তুকি পরিস্থিতি, সুদ হার, ব্যাংক ঋণ পরিস্থিতি, পুঁজিবাজার, রাজস্ব খাত, সঞ্চয়পত্র, মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধির বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা না হলে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থ সংকটের কারণে বিপুল অঙ্কের এই ভর্তুকি বহন করা সম্ভব নয়।
ফলে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকারের কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই। ওই বৈঠকে সুদের ব্যয় ও ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধিকে অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বাজেটে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ বিভাগ হিসাব করে দেখছে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে দেশে জ্বালানি তেল, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভর্তুকি বেড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও আগামীতে দেশের ভেতর এই মূল্য কমানোর কোনো প্রস্তাব করা হয়নি। ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। যা আগামী বছরের শুরুতে কার্যকর করতে বলা হয়েছে।
তবে কৃষকের সারের মূল্য পরে সমন্বয় করা হবে। সূত্র জানায়, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের পরও ভর্তুকি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি হবে।
বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হলেও বছর শেষে ধারণা করা হচ্ছে এটি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে চলে যেতে পারে।
যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি হবে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই বৈঠকে আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।
সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জন সম্ভব বলে বৈঠকে জানানো হয়। এতে বলা হয়, বর্তমান রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ভালো। গত বছরের তুলনায় রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ।
এর মধ্যে এনবিআর রাজস্ব আহরণ প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হয়েছে। পাশাপাশি গত নভেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে।
আর বাজেট বাস্তবায়ন হারও বেড়েছে তুলনামূলক ১০ শতাংশ। এছাড়া রপ্তানি ও আমদানি পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় আছে। রপ্তানি পণ্যের বাজার চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে আছে। ফলে এসব সূচক বিবেচনায় ধরে নিচ্ছে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচারের কথা উঠে এসেছে। বৈঠকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার রোধ করতে বন্ডেড ওয়্যার হাউসগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্রের সুদ কমায় সরকারি ব্যয় কমেছে। সরকার সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়েছে। এতে সরকারের সুদ বাবদ খরচ কমেছে, যা সামগ্রিকভাবে বাজেট ব্যয় কমানো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে আইএমএফ। গতকালের বৈঠকে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। বিষয়টিকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচনায় নেওয়া হয় বৈঠকে।
এ ছাড়া বিদেশি ঋণ সহায়তা ও অনুদানপ্রাপ্তির বিষয়টিতে আগামী বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। করোনা মহামারীর এ সময়ে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান উৎসাহিত করতে কর ও ভ্যাট ছাড়ের পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব বাজেট করার বিষয়টি মাথায় রাখছে সরকার। এ ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, এলডিসি থেকে উত্তরণ, সরকারি-বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোর মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। করোনার প্রথম ঢেউ সামলানোর পর করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সারাবিশ্বের মতো করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষও উদ্বিগ্ন। এ কারণে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। করোনার টিকা আমদানি ও চিকিৎসা ব্যয় সহজ করার মতো কর্মসূচি থাকবে আগামী বাজেটে। চলতি বাজেটে করোনার টিকা আমদানির জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। পাশাপাশি মহামারীকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়। এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ খাতে আরও বরাদ্দ প্রয়োজন। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে ডাবল ডোজের পাশাপাশি বুস্টার ডোজ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফলে টিকা কিনতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে।