করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নজিরবিহীন লকডাউন চলছে। এ লকডাউনে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন। স্থবির হয়ে গেছে সব কোলাহল। শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতি না, পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতি যে বড় ধাক্কা খাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে ইতিমেধ্যে আমাদের দেশেও যুগান্তকারী প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, এটা আমাদের যুদ্ধ। আর এবারের যুদ্ধে জয়ী হতে হলে সবাইকে যার যার অবস্থানে ঘরে থাকতে হবে। এটা সব শ্রেণি পেশার মানুষদের জন্য প্রযোজ্য। আইনজীবীরাও এর ব্যতিক্রম না।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই দেশের আদালতও বন্ধ। সরকারি ছুটি পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) পর্যন্ত বাড়ানোর কারণে দেশের সব আদালতে গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ছুটি ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের (হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ) উভয় বিভাগ ও দেশের সকল অধস্তন আদালত এই সাধারণ ছুটির আওতাভূক্ত। এর ফলে আইনজীবীরাও এখন কর্মহীন। এতে সবার সমস্যা হয়তো হবে না, তবে বিশেষ করে যারা নবীন আইনজীবী, তারা চরম ভোগান্তির শিকার হবেন। কারণ, তাদের আয় প্রবীণ আইনজীবীদের মতো নয়। এমনও অনেক নবীন আইনজীবী আছেন, যারা দৈনিক মাত্র তিন থেকে চারশ’ টাকা আয় করে থাকেন। দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তব সত্য।
এ বিষয় বিবেচনা করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ স্যার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গত ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার কাছে একটি আবেদন পাঠিয়েছেন বলে জেনেছি।
ওই আবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘আইনপেশায় ৫৫ হাজারের বেশি ব্যক্তি নিয়োজিত আছেন। তার মধ্যে একটি অংশ জুনিয়র হিসেবে কাজ করছেন। সাধারণত সিনিয়রদের প্রতিদিনের দেয়া অর্থই তাদের একমাত্র অবলম্বন। আদালত বন্ধ থাকায় তারা সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া জুনিয়রশিপ শেষ করে যারা নিজস্বভাবে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন, তাদেরও প্রথম কয়েক বছর সামান্য আয় দিয়ে চলতে হয়। দীর্ঘদিন কোর্ট বন্ধ থাকায় তারাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
করোনার কারণে দেশের সকল মানুষকে নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এবং এ আদেশ কার্যকর করতে অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছুটিতে দিনমজুর, রিকশাওয়ালা ও দৈনিক আয়ের লোকদের সংকটের কথা বিবেচনা করে সরকারি অর্থ বা খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাভাব বিবেচনা করে ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে।
এ অবস্থায় আইনজীবীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য ৩০০ কোটি টাকা প্রণোদনা তহবিল গঠন করার আহ্বান জানাচ্ছি। এ অর্থ থেকে প্রত্যেক জুনিয়র বা ক্ষতিগ্রস্ত আইনজীবীকে এক লাখ টাকা বিনাসুদে প্রদান এবং ২০২১ সালে চার কিস্তিতে পরিশোধের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করছি।’’
অন্যদিকে বার কাউন্সিলের সদস্য এ এফ মো রুহুল আনাম চৌধুরী মিন্টু স্যার নবীন জুনিয়রদের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন করেছেন।
এসব আবেদন নবীন আইনজীবীদের জন্য অবশ্যই আশার খবর। তবে এ দু’টো সংবাদে বুঝা যায়, সিনিয়র আইনজীবীদের মধ্যে হয়তো এ বিষয়ে সমন্বয় নেই। এজন্য তাদের প্রণোদনার টাকার পরিমাণের অংক একেক সময় একেক রকম। ফলে নবীন আইনজীবীদের মধ্যে হতাশা আরও বাড়ছে।
একজন আইনজীবী হিসেবে আমি জানি, একজন নবীন আইনজীবীকে তার সিনিয়র আইনজীবীর অধীনে কতোটা কাজ করতে হয়। কিন্তু সেই হিসাবে তারা তেমন সম্মানী পান না। সিনিয়রদের চেম্বারে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নবীনদের কাজ করতে হয় ভালো আইনজীবী হওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু দিন শেষে তারা সিনিয়রদের কাছে সম্মানী পান ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এ টাকা দিয়ে দুপুরের খাবার, গাড়ি ভাড়া ও নিজের আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হয়। সিনিয়র আইনজীবীরা দিনশেষে যে পারিশ্রমিক দেন, সেই অংক বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বলতে পারে না নবীনরা। এরপরও শত হতাশা, দুঃখ ও আশা বুকে বেঁধে আইন পেশায় তারা থাকেন এ পেশাকে ভালোবাসেন বলে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয়ই এটা জেনে থাকবেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু জীবনের বেশিরভাগ সময়ই মিথ্যা ও প্রতিহিংসামূলক মামলায় জেলে কাটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও কম ভুক্তভোগী নন। তিনি এসব কারণে হলেও দেশের আইনাঙ্গনে নবীনদের কষ্ট ও তাগ স্বীকারের কথা জেনে থাকবেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ, ব্যাংক থেকে নিজেদের সনদ নাম্বার জামানত হিসেবে রেখে ব্যাংক থেকে বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। একজন আইনজীবীর কাছে তার আইনপেশার সনদ কত মূল্যবান তা বলার বাইরে। এই সনদ নাম্বার জামানত হিসেবে ব্যবহার করলে তারা কখনোই ঋণখেলাপি হবে না। এছাড়া তারাও কিন্তু বছরে স্ট্যাম্প বিক্রিসহ নানা রাজস্ব খাতে ভেনাভোলেন্ট ফান্ডে লাখ লাখ টাকা দেয়।
নবীনরা এত কষ্ট স্বীকার করে সাধ্য অনুযায়ী নিজেদের মানি নিলেও করোনা তাদের জীবনকে এবার তছনছ করে দিয়েছে। এসব নবীন আইনজীবীরা কতো কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তা একজন আইনজীবী মাত্রই জানেন। অনেক আইনজীবী আছেন যারা সবেমাত্র ছোটখাটো চেম্বার নিয়ে বসেছেন। এদের অনেকেরই মাসের মাঝামাঝি অথবা ১/২ মাসের ভাড়া বকেয়া একসাথে দেন। করোনাভাইরাস গত মাসের মাঝামাঝি থেকে প্রকট আকার ধারণ করায় তাদের আয়ের উৎস বন্ধ। এটা তারা কোথাও বলতেও পারেন না, আবার পারেন না সইতেও। সিনিয়র যারা আছেন তারাও যদি এ মুহূর্তে জুনিয়রদের পাশে এসে না দাঁড়ান, সমন্বয়হীনতায় থাকেন, তাহলে নবীনরা কোথায় যাবে? নিজেরা দিতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যক্তিপর্যায়ে না গিয়ে সাংগঠনিকভাবে অনুরোধ জানান।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে সাত হাজারের বেশি উদীয়মান মেধাবী নবীন আইনজীবী বিভিন্ন জেলায় আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। করোনাভাইরাসে আইনজীবীদের মধ্যে তারা সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। কেননা এত অল্প সময়ে আইন পেশায় নিজের অবস্থান দাঁড় করানো সম্ভব না। এসব নিয়ে দুই এক জেলার আইনজীবী সমিতি ছাড়া কোনো সমিতিও পাশে দাঁড়ায়নি। এটা খুব কষ্টের।
এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অ্যাডভোকেট ওয়েলফেয়ার তহবিল আইন রয়েছে। ওই তহবিল থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। তিন বছরের চেয়ে কম সময় যারা প্র্যাকটিস করেছেন এবং যাদের বার্ষিক আয় এক লক্ষ টাকার কম তাদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা রয়েছে ওই আইনে। বাংলাদেশে এ ধরনের চিন্তাভাবনা নবীনদের জন্য নেই, আর আদৌ হবে কিনা জানি না।
বাংলাদেশেও প্রবীণ আইনজীবীরা নিয়ম মেনে বাৎসরিক চাঁদা দেন। নবীন আইনজীবীরাও যে চাঁদা দেন না, তা কিন্তু নয়। এত কষ্টের পরও একজন নবীন আইনজীবীকে চাঁদা দিতে হয়। তাহলে কেন আজ এক কঠিন দুঃসময়ে নবীনরা তাদের ফান্ড থেকে কিছু ঋণ হিসেবে পেতে পারে না? আর এই ঋণ যদি দেওয়া হয় তা যেন পরবর্তীতে ফান্ড থেকে কেটে নেওয়া হয়। নবীনরা কি আইনজীবী সমিতি থেকে বিশ, পঞ্চাশ হাজার বা এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাবে? দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দিলে তারা কি খেলাপি হবে? হবে না। তাদের সনদে রেডমার্ক লাগতে দেবে না তারা, এজন্য হলেও তারা খেলাপি হবে না।
আর যদি ব্যালেন্স ফান্ড থেকে নবীনদের টাকা দিতে রাজি না হন তাহলে বিনা সুদে ৪-৫ বছর মেয়াদের কিস্তিতে ১ লক্ষ করে টাকা দেওয়া হোক। তারা কারও অনুদান নিতে চায় না। অনেক নবীন আইনজীবী ফোন করে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, আমরা কারও অনুদান চাই না। সিনিয়ররা আছেন, আইনজীবী সমিতি আছে, তারা বসে একটা গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক সিদ্ধান্তে আসুক। কারও অনুদান না, বরং ঋণ দেওয়া হোক; যা তারা পরবর্তীতে শোধ করতে পারবেন। আইন পেশা একটি সম্মানজনক ও জনসেবামূলক পেশা। এ পেশায় নবীন আইনজীবীরা ভিক্ষুক নয়, তাই দয়া করে সহযোগিতার হাত বাড়ান, ভিক্ষুকের দৃষ্টি নয়।
এজন্য সরকারের ৭২ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে নিয়ে হোক, কিংবা আইনজীবীদের ফান্ড থেকে হোক; দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে সিনিয়র আইনজীবীদের কাছে অনুরোধ করছি। এতে যেন কোনো সমন্বয়হীনতা না থাকে। এই দুর্দিনে যদি সিনিয়র আইনজীবীরা জুনিয়র ও বিপদগ্রস্ত আইনজীবীদের পাশে দাঁড়ান, তাহলে দেশের আইন পেশার ইতিহাসে তাদের নাম অবশ্যই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিও অনুগ্রহ করে এ বিষয়টিতে নজর দিন। তাহলে এদেশের লাখো তরুণ আইনজীবীর স্বপ্ন টিকে থাকবে, নয়তো অকালেই ঝরে যাবে অনেক ফুল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)