করোনা ভাইরাস: ডেক্সামেথাসোন কোভিড-১৯ এর জীবনরক্ষাকারী প্রথম ওষুধ

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই স্বল্প মাত্রার স্টেরয়েড চিকিৎসা একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার।

বিজ্ঞানীরা বলছেন ডেক্সামেথাসোন নামে সস্তা ও সহজলভ্য একটি ওষুধ করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জীবন রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

এই ওষুধ ব্যবহার করলে ভেন্টিলেটারে থাকা রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি এক তৃতীয়াংশ কমানো যাবে। আর যাদের অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার এক পঞ্চমাংশ কমানো যাবে।

বিশ্বে এই ওষুধ নিয়ে সর্ববৃহৎ যে ট্রায়াল বা পরীক্ষা চালানো হচ্ছিল তার অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছিল এই ওষুধ করোনাভাইরাসের চিকিৎসায়ও কাজ করবে কিনা।

গবেষকরা অনুমান করছেন ব্রিটেনে যখন করোনা মহামারি শুরু হয়েছে তার প্রথম থেকেই যদি ডেক্সামেথাসোন ওষুধ ব্যবহার করা সম্ভব হতো তাহলে পাঁচ হাজার পর্যন্ত জীবন বাঁচানো যেত। কারণ এই ওষুধ সস্তা।

তারা বলছেন বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে কোভিড ১৯ রোগীদের চিকিৎসায় এই ওষুধ বিশালভাবে কাজে লাগতে পারে। এবং যেসব দেশ রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে এটা তাদের জন্য বিশাল সুখবর।

ভ্যাক্সিন :

মানবদেহে কোন জীবাণু প্রবেশ করলে এর বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি(নিরাপত্তা) সৃষ্টি করার জন্য কৃত্রিমভাবে যা প্রদান করা হয় তাই ভ্যাক্সিন (Vaccine)।পৃথিবীজুড়ে স্মলপক্স (Smallpox) রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল এবং পোলিও (Poleomyelitis), হাম (Measles) বা ধনুষ্টংকার (Tetanus)-এর মত রোগের প্রায় নির্মূলকরণ সম্ভব হয়েছে ভ্যাক্সিনেশন (Vaccination) বা টিকাপ্রদানের মাধ্যমে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্যমতে ২৫ টি রোগ আছে যাদেরকে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

যেভাবে এল ভ্যাক্সিন:

৪২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডিডেস (Thucydides) লক্ষ্য করেন যে এথেন্স শহরে যেসব রোগী স্মলপক্স আক্রান্ত হবার পর বেঁচে যাচ্ছে তাদের পুনরায় আর এই রোগটি হচ্ছে না। পরবর্তীতে চীনারা সর্বপ্রথম ১০ম শতাব্দীর শুরুতে ভ্যাক্সিনেশন এর আদিরূপ ভ্যারিওলেশন (Variolation) আবিষ্কার করে। এই প্রক্রিয়ায় স্মলপক্স রোগে আক্রান্তদের দেহের পাঁচড়া (Scrab) হতে টিস্যু নিয়ে সুস্থ মানুষদেরকে এর সংস্পর্শে আনা হত। ধীরে ধীরে তুরস্ক এবং ইংল্যান্ডেও ভ্যারিওলেশন বিস্তার লাভ করে। ১৭৯৬ সালে বৃটিশ চিকিৎসক ডাঃ এডওয়ার্ড জেনার আধুনিক ভ্যাক্সিনেশন আবিষ্কার করেন, এজন্যে তাঁকে “ফাদার অব ইম্যুনিলোজি” বলা হয়। শিক্ষানবীশকালে জেনার লক্ষ্য করেন যে গ্রাম্য এলাকায় গোয়ালাদের স্মলপক্স হয় না কারণ ইতোমধ্যেই তারা কাউপক্স আক্রান্ত হয়ে আছে। ১৭৯৬ সালে তিনি এক গোয়ালিনীর হাত হতে পুঁজ নিয়ে ৮ বছর বয়সী এক ছেলের বাহুতে আঁচড়ে দেন এবং ৬ সপ্তাহ পর তার শরীরে স্মলপক্স জীবাণু প্রবেশ করান। সৌভাগ্যবশত বাচ্চাটির স্মলপক্স হলনা। জেনার আরো গবেষণা করতে থাকেন এবং ১৭৯৮ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে স্মলপক্স ভ্যাক্সিন বাচ্চা-ছেলে-বুড়ো সবার জন্য নিরাপদ। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালে লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের(Rabies) ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেন এবং ভ্যাক্সিন জগতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা যখন বিভিন্ন রোগের কার্যকারণ আবিষ্কার করতে থাকেন তখন ভ্যাক্সিন তৈরীর পথও সুগম হয়ে যায়। জার্মান বিজ্ঞানী এমিল ভন বেহরিং ডিপথেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত সিরাম থেরাপি (Serum therapy) আবিষ্কারের জন্য ১৯০১ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পান।জাপানী চিকিৎসক শিবাসাবুরো কিতাসাতো ডিপথেরিয়া এবং ধনুষ্টংকারের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেন।

ভ্যাক্সিন যেভাবে কাজ করে?

জীবাণু থেকেই তার দ্বারা সৃষ্ট রোগের ভ্যাক্সিন প্রস্তুত করা হয়। যেকোন জীবাণুর আছে দুইটি বৈশিষ্ট্য- একটি হল রোগ সৃষ্টি করা (Pathogenecity)। অন্যটি দেহের অভ্যন্তরে ঐ একই রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কিছু পদার্থ (Antibody) তৈরী করা। ভ্যাক্সিন তৈরীর সময় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু অন্য বৈশিষ্ট্যটি ঠিক রাখা হয়। সোজা বাংলায় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাহীন জীবাণুকেই ভ্যাক্সিন হিসেবে দেহে প্রবেশ করানো হয়। ফলশ্রুতিতে এই জীবাণু দেহে রোগের কারণ হয় না, উল্টো রোগটি যেন না হয় তার জন্য বিশেষ পদার্থ(Antibody) তৈরী করতে থাকে। আরেকটি সুবিধা হল এই জীবাণুগুলো মেমরি সেল গঠন করে ফলে পরবর্তীতে একই জীবাণু পুনরায় প্রবেশ করলে সহজে সনাক্ত করতে পারে। এভাবে ভ্যাক্সিন শরীরের ইম্যুনিটি-কে বাড়িয়ে দেয়। ইঞ্জেকশন বা মুখে খাওয়ার মাধ্যমে ভ্যাক্সিন দেয়া যায়। ভ্যাক্সিনেশন দুই প্রকার- রোগ হবার আগেই ভ্যাক্সিন দেয়া (Active) আর রোগ হবার পরে দেয়া(Passive)।

অনেক সময় একটি ভ্যাক্সিনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এর সাথে আরেকটি ভ্যাক্সিন যোগ করা হয়। একে এডজুভেন্ট (Adjuvant) বলে। যেমন অ্যানথ্রাক্স ভ্যাক্সিনের সাথে পারটুসিস ভ্যাক্সিন যোগ করলে অ্যানথ্রাক্সের কাজ করার গতি বৃদ্ধি পায়। আবার ভ্যাক্সিন যাতে দূষিত না হয় এজন্য অনেক সময় এর সাথে প্রিজারভেটিভ (Preservative) মেশানো হয়।

যে সব রোগ ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব?

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ২৫ টি রোগের তালিকা করেছে যেগুলোকে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভবঃ
১ অ্যানথ্রাক্স (Anthrax)
২ হাম (Measles)
৩ রুবেলা (Rubella)
৪ কলেরা (Cholera)
৫ মেনিংগোকক্কাল ডিজিজ (Meningococcal disease)
৬ ইনফ্লুয়েঞ্জা (Influenza)
৭ ডিপথেরিয়া (Diptheria)
৮ মাম্পস (Mumps)
৯ ধনুষ্টংকার (Tetanus)
১০ হেপাটাইটিস এ (Hepatitis A)
১১ পারটুসিস (Pertussis)
১২ যক্ষা (Tuberculosis)
১৩ হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B)
১৪ নিউমোকক্কাল ডিজিজ (Pneumococcal disease)
১৫ টাইফয়েড (Typhoid fever)
১৬ হেপাটাইটিস ই (Hepatitis E)
১৭ পোলিও (Poleomyelitis)
১৮ টিক-বর্ণ এনকেফালাইটিস (Tick-born encephalitis)
১৯ হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (Haemophilus encephalitis type-B)
২০ জলাতংক (Rabies)
২১ ভেরিসেলা এবং হার্পিস (Varicella & herpes zoster)
২২ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (Human papilloma virus)
২৩ রোটাভাইরাস (Rotavirus gastroenteritis)
২৪ ইয়েলো ফিভার (Yellow fever)
২৫ জাপানীজ এনকেফালাইটিস (Japanese encephalitis)

ভ্যাক্সিনের প্রভাবঃ

২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্যমতে প্রতিবছর ভ্যাক্সিনেশনের ফলে আড়াই মিলিয়ন মৃত্যু প্রতিরোধ হয়। ভ্যাক্সিনেশনের পরিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি সাতটির মধ্যে একটি শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। এটা বলা যায় যে শিশুকালে যেসব রোগের ভ্যাক্সিন দেয়া হয় তা মোটামুটি ৯০-১০০% ইম্যুনিটি তৈরী করতে পারে। আরেকটি মজার ব্যপার হল একটি কম্যুনিটির বেশীরভাগ (মোটামুটি ৮০-৮৫%) মানুষকে ভ্যাক্সিনেশন করা গেলে ঐ কম্যুনিটির প্রায় সব সদস্য একই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভ করে (Herd immunity/Community immunity)। এই প্রক্রিয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম ইত্যাদি রোগের প্রতিরোধ করা যায়।

তথ্য:বিবিসি,ইন্টারনেট

বিস্তারিত আসছে।