করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই এলো সুপার সাইক্লোন আম্পান। কথায় আছে, বিপদ নাকি একা আসে না, সঙ্গে আরও দুই চারটাকে নিয়ে আসে। এবারও যেন তাই হলো। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল উপকূলীয় অঞ্চল। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আম্পানের তাণ্ডব বেশি চলেছে। আর বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সাতক্ষীরার বেশিরভাগ এলাকা।
সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব কতোটা চলেছে তা অন্যত্র বসেও বুঝা যায়। সেখানে বানের পানি থেকে বাঁচতে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ নির্মাণ করছে স্থানীয় মানুষ। ঈদের আনন্দ কিংবা করোনার ভয় এখন তাদের কাছে তুচ্ছ। এরচেয়েও জরুরি প্রয়োজন বাঁধ মেরামত করা। পানি থেকে নিজেদের বাঁচানো। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে পানির মধ্যে ঈদের নামাজ আদায়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে অনেকে রাজনৈতিক বিতর্ক করতে চাইলেও আসলে সেখানকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন সেখানে ঈদের আনন্দের চেয়েও বাঁধ মেরামত অতি জরুরি।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে যতটুকু খোঁজখবর নিতে পেরেছি তাতে বুঝা যায় আম্পান পরবর্তী পরিস্থিতি সেখানে তাদের জীবন-মরণ প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে। একদিকে আম্পানের তাণ্ডবে বাড়িঘর ভেঙে গেছে। এর ফলে খাবারের তীব্র সংকট। দ্বিতীয়ত: যেটুকু সম্বল আছে তাও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে লোনা পানি। এজন্য সরকারি সহায়তার চিন্তা না করে সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত ও নির্মাণ করতে বাধ্য হচ্ছে। করোনাভাইরাসের এই দূরত্বের সময়ও তা বজায় রাখতে পারছে না। সাতক্ষীরায় ভাইরাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ গুণ রোগী বেড়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে না পারাও এর কারণ হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সিডর, আইলা, বুলবুল, ফণীসহ এত ঘূর্ণিঝড় আসার পরও সেখানে কেন দীর্ঘমেয়াদী বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয় না? কেন এই অঞ্চলের মানুষের জীবন রক্ষায় স্থায়ী পরিকল্পনা হয় না? দেশের বিভিন্ন জায়গায় তো অঞ্চলভিত্তিক সেখানকার সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। উপকূলীয় অঞ্চল কেন এর ব্যতিক্রম? আসলে পরিকল্পনা যে হয় না তা নয়। পরিকল্পনা হয়। সেই অনুযায়ী সরকার বরাদ্দও দেয়। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের দুর্নীতি এবং অদক্ষতার কারণে সরকারের অনেক ভালো পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হয় না। ঘূর্ণিঝড় আম্পান সেই বিষয়টি আবার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। এজন্য সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা, কষ্ট লাঘব করা এবং সরকারের সুনাম রক্ষায় সরকারের দায়িত্বশীলদেরই এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণসহ সরকারের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আম্পানের পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার নানা ভিডিও এবং সংবাদ চোখে পড়ে। সংবাদমাধ্যমের সেসব নিউজে সাধারণ মানুষের না খেয়ে থাকার চিত্রও দেখা যায়। বুকের চাপা কষ্ট আর কান্না লুকিয়ে এরপরও তারা বলছেন, ত্রাণ লাগবে না আমরা বেড়িবাঁধ চাই। একে তো করোনাভাইরাস বিপর্যয়, তার ওপর আম্পানের এসব সংবাদে মনের কষ্ট আরও বাড়ে। আমার বিশ্বাস, সরকারের সংশ্লিষ্টরাও এসব সংবাদ দেখছেন। তাদেরও হয়তো একই অনুভূতি হয়। লকডাউনে স্বাভাবিক পরিস্থতি নেই এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবুও দুর্যোগ মোকাবেলায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণসহ জরুরি বরাদ্দ দিন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিন। উপকূলের মানুষের এই দুর্দিনে যদি আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে আর কবে দাঁড়াবো?
করোনাভাইরাস এবং আম্পানের এই দুর্যোগে আরেকটা কথা বলতে চাই। তা হলো- দুর্গত মানুষদেরকে রাজনৈতিক জটিল মারপ্যাঁচের হিসাবে না ফেলে আমরাও যেন যার যার অবস্থান থেকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কারণ, এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর কেউ যদি এগিয়ে আসতে নাও পারেন, তবে তিনি বা তারা যেন দুর্গত মানুষদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেন। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের কান্নার এই সময়ে আমরা কি এটুকু করতে পারবো না?
ছবি সৌজন্য: শাহিন বিল্লাহ
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)