শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকার বিভাগে এখনও রয়ে গেছে আওয়ামী লীগ ব্যাকগ্রাউন্ডের সুবিধাভোগী অনেক কর্মকর্তা। এদের অনেকেই ভোল পাল্টে এখন স্রোতের সাথে চলার অপচেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব কর্মকর্তারা নিয়মিত পতিত স্বৈরাচারের কাছে স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও নথিপত্র সরবরাহ করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
স্বৈরাচারের চিহ্নিত দোসর এসব দুর্নীতিবাজ আওয়ামী কর্মকর্তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ গতিশীল হবে না বলে জানিয়েছেন দীর্ঘদিন নিপীড়নের শিকার হওয়া কর্মকর্তারা।
বিএনপিপন্থী জনপ্রতিনিধিদের ‘যমদূত’ জাহাঙ্গীর হোসেন
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে স্থানীয় সরকারে বিএনপিপন্থী জনপ্রতিনিধিদের কাছে ‘যম’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন। উপজেলা-১ এবং উপজেলা-২ শাখায় কর্মরত থাকাকালে স্হানীয় সরকার বিভাগের সাবেক যুগ্মসচিব মোঃ আকরাম আল হোসেন (পরবর্তীতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব) এর ক্ষমতা অপব্যবহার করেন তিনি। বিনা অপরাধে বিএনপি সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আওয়ামী দলীয় সন্ত্রাসী দিয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগ তদন্ত করে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ হতে বহিষ্কার করে আওয়ামী দলীয় সন্ত্রাসীদের প্যানেল চেয়ারম্যান পদে বসানোর অন্যতম বুদ্ধিদাতা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন। এজন্য বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপিপন্থী জনপ্রতিনিধিদের কাছে তিনি ‘ইবলিশ’ ও ‘যমদূত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেনের বেশকিছু নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, তিনি ২০১৫ সালে ঢাকায় ২টি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ শাখায় পদায়িত হলে বিভিন্ন জেলা পরিষদ হতে নামে বেনামে প্রকল্প গ্রহণ করে বিপুল অর্থ অর্জন করেন। নিজ জেলা পটুয়াখালীতে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। বিগত ১৫ বছরে অর্থ-সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেছেন তিনি। এছাড়া নিজ স্ত্রীর নামে এবং আত্নীয়-স্বজনের নামে রয়েছে কোটি টাকার শেয়ার, বন্ড ও সঞ্চয়পত্র।
আওয়ামী তদবিরে বিনা পরীক্ষায় চাকরি পান সোহাগ
মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা মেধার জোরে চাকরি না পেলেও স্হানীয় সরকার বিভাগে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সচিব আবদুল মালেক এর তদবিরে বিনা পরীক্ষায় চাকরি পেয়েছেন মোঃ সোহাগ। এক্ষেত্রে একটাই যোগ্যতা ছিল তার, ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন সোহাগ। ইউনিয়ন পরিষদ-১ শাখা এবং জেলা পরিষদ শাখায় কর্মরত থাকা অবস্থায় বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। ইউনিয়ন পরিষদ-১ শাখায় কর্মরত থাকা অবস্হায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নামে বিভিন্ন অভিযোগ দিয়ে অর্থ গ্রহণ করতেন। বিএনপিপন্থী তৎকালীন একাধিক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তার দ্বারা ভুক্তভোগী ছিলেন বলে জানিয়েছেন।
মাহবুবউল আলম হানিফ পালালেও বহাল তবিয়তে মশিউর
অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরী করতেন ঝিনাইদহের শিতালী গ্রামের মোঃ মশিউর রহমান। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়ে স্হানীয় সরকার বিভাগে ২০১৬ সালে চাকরি নেন তিনি। এরপর আওয়ামী প্রভাবে স্হানীয় সরকার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ জেলা পরিষদ শাখায় পদায়ন হয় মশিউরের। জেলা পরিষদ শাখায় পদায়িত থাকার কারণে তার ভাইয়ের নামে ঠিকাদারী লাইসেন্স করে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন অফিসে ঠিকাদারী কাজ শুরু করেন তিনি। পানি সরবরাহ-২ শাখায় কর্মরত থাকা অবস্হায় ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেন। মশিউর রহমান ওয়াসায় বিভিন্ন পদে ১১ জনকে নিয়োগ দিয়ে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। তার নামে ঢাকার নিকট ৫ কাঠার ২টি প্লট রয়েছে। স্ত্রীর নামে এবং আত্মীয়ের নামে রয়েছে ৩০ লক্ষ টাকার শেয়ার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে এলাকায় ছিল তার আধিপত্য। আওয়ামী লীগের মাহবুবউল আলম হানিফ পালিয়ে গেলেও স্থানীয় সরকার বিভাগে এখনও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন তার দোসর মোঃ মশিউর রহমান।
সাবেক মন্ত্রী রাজ্জাকের প্রভাবে স্থানীয় সরকারে চাকরি, বদলি বাণিজ্য করে কোটিপতি
এছাড়াও স্হানীয় সরকার বিভাগে আওয়ামী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক (পরবর্তীতে কৃষি মন্ত্রী) এর পরিচয়ে চাকরী নেয় আরেক ছাত্রলীগ কর্মী, টাঙ্গাইলের সখিপুরের মোঃ আব্দুল মজিদ। তিনি ২০১৬ সালে স্হানীয় সরকার বিভাগে চাকরিতে যোগদান করে পদায়িত হন পৌর-১ শাখায়। পৌর-১ শাখায় ৪ বছর কর্মকর্তা থাকা অবস্হায় পৌরসভার কর্মচারীদের বদলি বাণিজ্য করে প্রায় কোটি টাকা অর্জন করেন। বিভিন্ন অভিযোগ থাকার পরও তাকে কম গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পদায়িত না করে জেলা পরিষদ শাখায় পদায়ন করা হয়। জেলা পরিষদ শাখায় কর্মরত থাকা অবস্হায় বিশেষ বরাদ্দের নামে কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের জেলা টাঙ্গাইলের মোঃ আব্দুল মজিদ।
স্থানীয় সরকারে গোপালগঞ্জের কোটিপতি ইকবাল, বিশৃঙ্খলায় মদদ
স্হানীয় সরকার বিভাগে আরেক ছাত্রলীগ কর্মীর পরিচয়ে চাকরী নেয় গোপালগঞ্জের ইকবাল হোসেন। চাকরির কয়েকদিন পর গোপালগঞ্জের ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পদায়িত হয় পৌর-২ শাখায়। পৌর-২ শাখায় কর্মরত থাকা অবস্হায় প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেন ইকবাল হোসেন। স্ত্রীর নামে এবং বেনামে রয়েছে বন্ড ও সঞ্চয়পত্র এবং ঢাকার অতি নিকটে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। স্বৈরাচার পতনের পর গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের ব্যানারে হওয়া বিশৃঙ্খলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ইকবাল হোসেন এর বিরুদ্ধে।
এখনও লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান দুলাল, নারী সহকর্মীরা ছিল অসহায়
স্হানীয় সরকার বিভাগে সিরাজগঞ্জের আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী নাসিমের তদবিরে চাকরি পায় মোঃ দুলাল হোসেন। নাসিমের তদবিরে পদায়িত হয় গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা-২ শাখায়। উপজেলা পরিষদের থোক বরাদ্দ দিয়ে সে অর্জন করে কোটি টাকার সম্পদ। পরবর্তীতে তাকে পদায়িত করা হয় এলজিইডি শাখায়। প্রকল্পের অর্থ ছাড়, ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দিয়ে অর্জন করেন আরও কোটি টাকার সম্পদ। প্রাধিকার না থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে তিনি বসবাস করেন আজিমপুর সরকারী কলোনীর উচ্চ শ্রেণীর বাসায়।
তিনি সবসময় নারী সহকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন হোটেলে/রেস্তোরায় আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্হানীয় সরকার বিভাগের সহকর্মীকে নিয়ে প্রায় সময় হোটেলে রাত্রী যাপন করতেন। স্থানীয় সরকার বিভাগে বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট।
ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে স্হানীয় সরকার বিভাগের একটি আওয়ামী সমর্থনপুষ্ট কর্মীদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন। এই সমিতির নাম করে সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন হোটেল/রেস্তোরায় সমবেত হয়ে ছাত্রলীগের এজেন্ডা কিভাবে স্হানীয় সরকার বিভাগে এখনও প্রতিষ্ঠিত করা যায় এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
অনেক অফিসের কেরানীও ফ্যাসিবাদের দোসর: উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
স্থানীয় সরকার বিভাগকে ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করার লক্ষ্যে এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক আসিফ মাহমুদ। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনিও স্বীকার করেছেন ফ্যাসিবাদের দোসরদের সক্রিয় থাকার কথা। রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে গণঅভ্যুত্থানের ৩ মাস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও ফ্যাসিবাদের দোসরদের শেকড় অনেক গভীরে রয়ে গেছে। অনেক অফিসের কেরানীও তাদের দোসর।
আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, বিগত সময়ে যে ফ্যাসিবাদী সরকার ছিল, তাদের পলিসিগুলোই ছিল গণবিরোধী, গণতন্ত্র হত্যাকারী এবং মানুষের জীবন নেওয়ার মতো পলিসি ডিসিশন তারা দিয়েছে এবং প্রশাসনে থাকা তাদের দোসররা সেগুলো বাস্তবায়ন করেছে।
নিপীড়নের শিকার বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সাথে একমত পোষণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগসহ প্রশাসনের সকল জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী দোসরদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দীর্ঘদিন আওয়ামী নিপীড়নের শিকার ও বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা বলছেন, কেরানী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন বা পুনর্বাসনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেজন্য স্বৈরাচার শেখ হাসিনার মতো তার দোসরদেরও প্রশাসনের সকল স্তর থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। নাহলে গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট কখনও বাস্তবায়ন হবে না।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: ইমরান খান
কার্যালয়: গ-১৩৩/৩, প্রগতি স্মরণী, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। মোবাইল: ০১৮৫৩-৫৪৬২৫৪
প্রিয়দেশ নিউজ কর্তৃক সর্বসত্ব ® সংরক্ষিত