১৯৪৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইতিহাসের নজিরবিহীন গ্লানির মুখে পড়েছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগ্রামী সংগঠন হামাসের মুহূর্মুহু হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ইহুদিবাদী এই দেশটি। আধা ঘণ্টায় হামাসের ৭ হাজারেরও বেশি রকেট হামলায় ইসরায়েলের বহু নাগরিক নিহত হয়েছে। এছড়া ইসরায়েলের অসংখ্য মানুষকে দেশটির ভেতরে ঢুকে ফিলিস্তিনে আটক করে নিয়ে এসেছে হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা।
এরমধ্যে অসংখ্য ইসরায়েলের সৈন্য এমনকি জেনারেলও রয়েছে। ইরানি সংবাদমাধ্যম পার্স টুডে বলছে, এমন প্রেক্ষাপটে দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী একদিকে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে গাজায় হামলা চালাচ্ছ্নে, অন্যদিকে বহু সৈনিক ও সাধারণ ইসরায়েলিদের বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য হামাসের কাছে ধর্না দিয়ে আলোচনার পথ বেছে নিয়েছেন।
ইসরায়েলি সংবাদপত্রের মতে, হামাসের অভিযানে দুই শতাধিক ইসরায়েলি নিহত এবং সহস্রাধিক আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে। স্থল, আকাশ এবং সমুদ্র থেকে একযোগে ওই অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে ইহুদিবাদী বহু সেনাও গ্রেফতার হয়েছে। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইহুদিবাদী বসতি ‘নাহাল ওজ’ও দখল করেছে। তারা অধিকৃত অঞ্চলের দক্ষিণে ইসরায়েলি সেনাদের একটি বিমান ঘাঁটিতে প্রবেশ করে তাদের বেশ কয়েকটি এফ-১৬ বোমারু বিমান গাজায় স্থানান্তর করেছে। ইসরায়েলপন্থী টিভি, চ্যানেল-থার্টিন জানিয়েছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের এই অভিযান ছিল ২০০৮ সালের পর থেকে নজিরবিহীন।
এখন প্রশ্ন হলো- হামাস হঠাৎ করেই এমন নজিরবিহীন অভিযান কেন শুরু করল? আর ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারে রেখে তারা কিভাবে ইসরায়েলের ভিতরে ঢুকে অপারেশন চালালো? এর জবাবে হামাস বলছে, ‘কোনো জবাবদিহি ছাড়া ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরাইলের লাগামহীন অপরাধযজ্ঞের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাদের সময় শেষ। আমরা অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড শুরু করেছি এবং অভিযান শুরুর ২০ মিনিটের মধ্যেই পাঁচ হাজারের বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছি।’
এছাড়া জানা যায়, শুক্রবার সন্ধ্যায় অধিকৃত পশ্চিম তীরে দখলদার ইসরাইলিদের হামলায় শহীদ এক ফিলিস্তিনি তরুণের দাফন অনুষ্ঠানে হামলা চালায় ইহুদিবাদীরা। এর পরদিন সকালের দিকে হামাস ইসরাইলকে লক্ষ্য করে এই রকেট হামলা শুরু করে।
হামাসের উপপ্রধান সালেহ আল-আরোওরি বলেন, ‘এখনকার পরিস্থিতিতে যেকোনো কিছুই সম্ভব। আমরা স্থলপথে ইসরায়েলের হামলা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত। এটা হামলা চালানো আর পালিয়ে যাও—এমন কোনো অভিযান নয়। আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছি। যুদ্ধ চালিয়ে যাব। এই যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো স্বাধীনতা এবং পবিত্র স্থানগুলোর স্বাধীনতা রক্ষা করা। বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত এই লড়াই চলবে। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকার আছে। নিজেদের পবিত্র স্থান রক্ষায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার অধিকার রয়েছে।
অন্যদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইসরায়েল সরকার দেশজুড়ে ৪৮ ঘণ্টার জরুরি অবস্থা জারি করেছে। পাশাপাশি গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন এক হাজার ৬১০ জন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের জন্য বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই হামলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করতে হয়েছে হামাসকে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে অন্য অনেকের চেয়ে ভালো জানে ফিলিস্তিনি এই সংগঠন। ফলে এই হামলার বিষয়টি যাতে ফাঁস না হয়, সে জন্য নানাভাবে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিতে হয়েছে এবং তাদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে হয়েছে। ইসরায়েলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামাসের এই হামলা নিয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বড় ধরনের একটি তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে এ তদন্ত শেষ করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন কনফ্লিক্ট বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, হামাসের এবারকার অভিযানে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ব্যর্থতার ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতা যুক্ত হলো। এই ব্যর্থতা নেতানিয়াহুর জোট সরকারের পতন ডেকে আনতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা অধিকৃত ফিলিস্তিনে তাদের পা রাখার পর থেকে এরকম পরাজয় আর অপমানের সম্মুখিন কোনোদিন হয়নি।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নেতানিয়াহুর সামনে এই ক্ষতি পূরণ করার কোন উপায় নেই। পরিস্থিতি অন্য দিকে ঘোরাতে নেতানিয়াহু বড় আকারের কোনো অভিযান যদি ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে শুরু করেন, তাহলে তার পরিণতি যে কীরকম ভয়ংকর হবে তা হামাসের অভিযান থেকে নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়।
তবে পরিস্থিতি যাই হোক, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধান ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে যুদ্ধ পরিস্থিতি বন্ধ হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে সব পক্ষকে শান্ত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু সেরকম কোনো পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো সরাসরি দখলদার ইসরায়েলের পক্ষে বিবৃতি দিচ্ছে। আবার ইরান, ইরাক, কাতার ও সিরিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ হামাসের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এতে আপাতত যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এতে নিশ্চয়ই খালি হবে আরও বহু মায়ের কোল, সন্তান চিরদিনের জন্য হারাবে তার নিরাপদ আশ্রয়, কিংবা বহু নরনারী হারাবে তার প্রিয়জন। যেটা আমাদের কারোই কোনভাবে কাম্য নয়।