বিটিআরসি’র দুর্নীতিবাজ আমজাদ-মাহদীকে বাঁচাতে মরিয়া অসাধু সিন্ডিকেট

নিজস্ব প্রতিবেদক
৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের সব সেক্টরে বৈষম্য দূরীকরণ এবং অনিয়ম দূর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু হয়েছে। দেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)তেও এর আঁচ লেগেছে। সীমাহীন দূর্নীতি অনিয়মের অনিয়মের অভিযোগে চলতি মাসের ১১ তারিখে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বিটিআরসির উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ও চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব আমজাদ হোসেন নিপু এবং তার বিভিন্ন অপকর্মের দোষর ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন বিভাগের উপ-পরিচালক মাহদী আহমেদকে। আমজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক এবং সাবেক দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যানের দূনীতির সহযোগী। অপর উপ-পরিচালক মাহদী যার পিতা বিটিসিএল এর প্রাক্তন এমডি মাহফুজ উদ্দিন আহমদ। যিনি বর্তমানে ৪৮০০ কোটি টাকার দুর্নীতির দায়ে দুদকের চার্জশিটভুক্ত আসামী। বিটিআরসি’র এই অসাধু দুই কর্মকর্তাকে বাঁচাতে মরিয়া কমিশনের অসাধু একটি সিন্ডিকেট।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিটিআরসি’র সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ যোগদানের পরপরই পুরো কমিশনে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপে সচেষ্ট হন। এ লক্ষ্যে তিনি তার ঘনিষ্ট কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সাবেক প্রচার সম্পাদক আমজাদ হোসেন নিপুকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিজের একান্ত সচিব হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে পদায়ন করেন।

একান্ত সচিব হিসেবে পদায়নের পরই আমজাদ হোসেন তার অনিয়ম দূর্নীতির ডালপালা মেলতে থাকেন। সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিটিআরসি’র বিভিন্ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের ঘনিষ্ট দেশবিরোধী ও দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরী করেন আমজাদ। যারা বিটিআরসি’র প্রতিটি বিভাগের কর্মবন্টনের ৭০-৭৫% কাজ নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। এজন্য ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন্স বিভাগের উপ-পরিচালক মাহদী আহমদ-কে যাবতীয় কমিটি ও কার্যক্রমের দায়িত্ব প্রদান করে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে কর্মপরিবেশ নষ্ট করেন। তাদের সিন্ডিকেটের অন্তর্ভূক্ত কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ ঘনঘন বিদেশ ট্যুর নিশ্চিত করেন এই মাহদী-আমজাদ গং। কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জিও সমূহতেই তার প্রমান মেলে।

বিটিআরসি’র বেশ কয়েক জন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, আমজাদ- মাহদী সিন্ডিকেট টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ, পদায়ন ও বিভিন্ন বিভাগের কার্যবন্টন, লাইসেন্স বাণিজ্য, বিভিন্ন সার্ভিস অপারেটর ও লাইসেন্সির নিকট হতে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে মাসিক হারে অর্থ আদায়, ইন্সপেকশনের নামে বাণিজ্য, বিদেশ ভ্রমণ, টেলিযোগাযোগ আইন ভঙ্গ করে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের শেয়ার হোল্ডার বনে যাওয়াসহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমের একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোপূর্বে পদত্যাগী চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন এই আমজাদ-মাহদী ও মহাপরিচালক (ইএন্ডও) এর সুপারিশে লাইসেন্সিং গাইড লাইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সামিট কমিউনিকেশন্স লিঃ এর এনটিটিএন লাইসেন্স এর শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফি ১০ কোটি টাকা বিধি বহির্ভূতভাবে মওকুফ করেন। যা বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম সেই অর্থ আদায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। বিটিআরসি’র টেন্ডার ও ক্রয় প্রক্রিয়ার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আমজাদ হোসেন বিভিন্ন কমিটির সদস্যেরকে ইচ্ছামতো পরিবর্তনের করে আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাদেরকে যুক্ত করেন। সম্প্রতি, রেডিয়েশন পরিমাপক সংক্রান্ত ১৫ কোটি টাকার দরপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পিপিআর এর বিধি বহির্ভূতভাবে দরপত্র উন্মুক্ত করার মাত্র এক ঘন্টা আগে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরিয়ে কমিটি সংশোধন করে আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করেন। এভাবেই মাহদী আহমেদ কমিশনে একাই ক্রয় সংক্রান্ত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্ধ শতাধিক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, যা বিটিআরসি’র ইতিহাসে নজিরবিহীন।

এছাড়াও উপ পরিচালক আমজাদ সরকারের সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের ১৬০০ কোটি টাকা নিয়ে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। ১৬০০ কোটি টাকার মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ব্যাংক মুনাফা তাদের নিজস্ব একাউন্টে স্থানান্তর করেন। যা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকারি বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্পন্সর সংগ্রহের নামে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান হতে জোর জবরদস্তি করে চাঁদা সংগ্রহ করে ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা করার বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।

এখানে উল্লেখ্য যে, মোস্তাফা জব্বার মন্ত্রী থাকাকালে আমজাদ হোসেন সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের ধারাবাহিক সভা আয়োজনের নামে আপ্যায়ন খাতে ভাউচার ছাড়া প্রায় কোটি টাকা তছরুফ করার অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট নথি গায়েব করা হয়। এ বিষয়ে সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যানকে অভিযোগ জানানো হলেও তিনি কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ফলে সীমাহীন দলীয়করণ, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী কার্যক্রমের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা।

এ সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং কমিশনকে বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত এবং রাষ্ট্রবান্ধব করে গড়তে গত ১১ আগস্ট ২০২৪ তারিখে কমিশনের ৩০০ জনের অধিক কর্মচারী কমিশনের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের অপসারণ ও সকল বৈষম্য নিরসনে আন্দোলনের ডাক দেয়। একইসাথে বিগত দিনে বিভিন্ন দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং প্রকাশিত খবরের প্রেক্ষিতে দুর্নীতিগ্রস্থ ০২(দুই) উপ-পরিচালককে চাকুরী হতে অপসারণ ও টেলিযোগাযোগ সেক্টরে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধসহ কমিশনে ১০ দফা দাবী পেশ করে।

এছাড়াও আন্দোলনকারীদের নতুন বাংলাদেশ গঠনে এবং বৈষম্য দুর করার জন্য আমাদের সন্তানরা যেভাবে নতুনভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে, যে পথ আমাদের দেখিয়েছে সে ধারাবাহিকতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমিনুল হক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং জনাব মুসফিক মান্নান, কমিশনার অর্থ,হিসাব ও রাজস্ব বিটিআরসি থেকে সকল অন্যায় ও সকল বৈষম্য দুর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে গত ১৩ আগস্ট তারিখে কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হলেও অজ্ঞাত কারণে সেই সভার রেজুলেশন বের করা হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের একাধিক কর্মচারী এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন যে, ছাত্র জনতার আন্দোলনে সারা দেশে পরিচালিত ডিজিটাল ক্র্যাক ডাউন এর পর ইন্টারনেট খুলে দেওয়ার সময় আইএসপি/ক্যাশসার্ভার নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা আর্থিক -বানিজ্যও করেছেন। যা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বাচাঁতে ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন বিভাগে ব্যাক ডেট দিয়ে নথি অনুমোদনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়াও দুর্নীতির দায়ে সাময়িক বরখাস্তকৃত ০২(দুই) উপ-পরিচালক’কে রক্ষায় সিন্ডিকেটের সদস্যদের তৎপরতা লক্ষনীয়।

উল্লেখ্য, বর্তমান কমিশনার (এসএস) বিগত সময়ে মহাপরিচালক (প্রশাসন) হিসাবে প্রেষণে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ লিখিত পরীক্ষার রেজাল্টশীট পরিবর্তন করে মেধাবীদের অবমূল্যয়ন ও প্রকল্প পরিচালক থাকাকালীন বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে অডিট আপত্তি উত্থাপিত হলে তিনি অর্থ এবং ক্ষমতার জোড়ে তা ধামাচাপা দেন।

কর্মচারীদের দাবী অনুযায়ী, সাময়িক বরখাস্তকৃত ০২(দুই) উপ-পরিচালকের বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হলেও কমিশনে বিদ্যমান অন্যান্য দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের অবৈধ ক্ষমতার ইশারায় ও তাদের মাধ্যমে সুবিধাভোগী সহযোগীদের হস্তক্ষেপের কারণে একটি পক্ষপাত দুষ্ট কমিটি গঠনের চেষ্টা এবং নিরপেক্ষ কমিটি গঠনে গড়িমসি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কি কারণে দুর্নীতির দায়ে সাময়িক বরখাস্তকৃত কর্মকর্তাদের পক্ষ অবলম্বন করে কমিটি গঠনে কতিপয় উর্ধ্বতন কর্মকতা ব্যঘাত সৃষ্টি করা করছেন সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এ বিষয়ে কমিশনের একাধিক কর্মচারী আশংকা প্রকাশ করছেন যে, নিরপেক্ষ কমিটি গঠন না করা হলে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকা সত্বেও অভিযুক্তরা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থেকে যাবে। এছাড়াও তাদের যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত দাবীর কথা বলতে গিয়ে সাধারণ কর্মচারীরা এসিআর এর হুমকিসহ নানা ভাবে ভয়ভীতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাই উপরিল্লিখিত সাময়িক বরখাস্তকৃত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগী এবং সুবিধাভোগিদের কমিশন হতে দ্রুত অপসারণ করা না হলে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিনত হবে। তাই, এ অবস্থা হতে উত্তোরণ, কমিশনের কর্মচারীদের মৌলিক দাবীসমূহ পূরণ এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগী এবং সুবিধাভোগিদের দ্রুত অপসারণের জন্য অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন কমিশনের সাধারণ কর্মচারীরা। অন্যথায় লাগাতার আন্দোলন যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।