র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা কি মানবাধিকার ইস্যু নাকি অন্যকিছু?

101

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব) এর সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলেও বিষয়টিকে শুধু মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বলতে নারাজ বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ভৌগলিক কারণে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে চীনপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়াসহ বাংলাদেশ সরকারের সাথে টানাপোড়েনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কঠোর অবস্থানে যেতে পারে।

এছাড়াও উপমহাদেশের রাজনৈতিক কূটচালে তৃতীয় কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করেও এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাতে পারে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভৌগোলিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশ সবসময় বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বিশ্বে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো নানা ইস্যুতে বাংলাদেশকে তাদের পাশে পাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। যেকোন ধরনের যৌক্তিক বিষয়ে বাংলাদেশও বিভিন্ন ফোরামে কিংবা সভায় বাংলাদেশের সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব প্রতিপত্তিতে চীনের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান না হওয়ায় কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ না করায় চীনের প্রতি রুষ্ট হয়ে তারা বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। তবে উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের প্রভাব বেশি। আবার এমনও হতে পারে- অন্য কোন রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রকে প্রণোদিত করে বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়েছে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান যথাযথ বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কূটনীতি, পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশ নিজেরাই ঠিক করবে। পৃথিবীর সব দেশই বিদ্যমান সংকট, সমস্যা তথা পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তিতে সম্পর্কগুলো পুনঃনির্ধারণ করে থাকে। এদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ চীন, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়বে নাকি অন্য কারও সাথে গড়বে সেটা তারাই ঠিক করবে। এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও হচ্ছে- সবার সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে শত্রুতা নয়। এই নীতির ফলেও চীন বা অন্য কোনো দেশের সাথে শত্রুতা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে মাদকবিরোধী অভিযানে নিহতের কথা বলেছে। এ বিষয়ে চবি’র ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের এ সহকারী অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জনগণের স্বার্থে সুরক্ষিত রাখার প্রয়াসে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। আর মাদক তো শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। এ সমস্যা বিশ্বব্যাপী রয়েছে। এজন্য পৃথিবীর বহু দেশে মাদকবিরোধী অভিযান হয়। এসব অভিযানে কঠোরতাও প্রদর্শন করতে হয়, মাদক নির্মূলের স্বার্থে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র গত ১০ ডিসেম্বর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের সাবেক ডিজি এবং পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদসহ র‌্যাবের ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেখানে ২০১৮ সালে কক্সবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক, গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চলমান নিষেধাজ্ঞার ফলে এই কর্মকর্তাদের ব্যাংকিং লেনদেনে কোনো আইনি ঝামেলা হবে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ব্যারিস্টার জাহিদ রহমানের কাছে। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নয়। ফলে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ব্যাংকিং লেনদেনে আইনী বাধা তখনই আসতে পারে, যদি বাংলাদেশে উক্ত সংস্থা এবং সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের অভিযোগ প্রমাণ হয়। এছাড়া বাংলাদেশে তাদের ব্যাংকিং লেনদেনে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তবে যে দেশ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে, সেই দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তি অথবা সংস্থার ব্যাংকিং লেনদেন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হতে পারে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান।

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার বিগত নির্বাচনে বিজয়ের লক্ষ্যে র‌্যাবের অধীনে গুজববিরোধী সেল তৈরি করেছিল। এজন্য বিরোধী পক্ষ ভয়ে অনলাইনেও তেমন কোনো প্রচারণা চালাতে পারেনি। এবার তেমন যেন না হয় সেজন্য নির্বাচনের দু’বছর আগেই কি এমন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে সহিংসতা ঘটে থাকে। এখানে যে ধরনের সহিংসতা হয় তা প্রতিরোধকল্পে বিশেষ কোনো বাহিনীর বদলে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে নির্বাচনে সহিংসতা বিরোধী সেল গঠিত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের কোনো বাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এমন নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞায় রাজনৈতিক ব্যর্থতা কতটুকু? এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের জবাবও দিতে দেখা গেছে সরকার বিরোধী একটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে। এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে চবির ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো এর দায় এড়াতে পারে না। মানুষের মধ্যে ভোট না দেয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই সরকার এবং বিরোধী পক্ষের বাকযুদ্ধ চলছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিষয়টির তীব্র সমালোচনা করলেও বিএনপি বলছে, তারা এতদিন ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে দাবি করে আসছিল সেই দাবিই এখন বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে প্রমাণিত। অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞাকে দুঃখজনক এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন বলে দাবি করলেও এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হবে না বলে আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন।