বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে দেশে যখন মুজিব জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন হচ্ছে, তখন এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেল সুনামগঞ্জের শাল্লায়। শাল্লা উপজেলার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে কয়েক হাজার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী।
এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঠিক কী কারণে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলো? এমন প্রশ্ন ছিল সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের একজন নেতা মামুনুল হককে নিয়ে এক হিন্দু ব্যক্তির স্ট্যাটাস দেয়ার জের ধরে কয়েক হাজার মানুষ বুধবার সকালে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালায়।
এসময় তারা অন্তত ৮৮টি বাড়িঘর ও সাত-আটটি পারিবারিক মন্দিরে ভাংচুর করে এবং লুটতরাজ চালায়।
সংবাদমাধ্যমের কাছে ওই হামলার বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী কয়েকজন নারী। এছাড়া স্থানীয় সাংবাদিকরাও ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।
এই সাম্প্রদায়িক হামলার সময় দুই সন্তানের মা লবঙ্গ রানী এবং তার পুত্রবধু বাসায় নিজেদের কাজ করছিলেন। তাদের ভাষায়, ‘হঠাৎ খবর পাই দু’দিক থেকে নৌকায় করে লাঠিসোটা নিয়ে লোকজন আসছে। বউকে নিয়ে ওই অবস্থাতেই ঘরে তালা দিয়ে দৌঁড় দেই হাওরের বাঁধের দিকে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখি ঘরবাড়ি তছনছ হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘শব্দ শোনা যাচ্ছিলো যে ভাংচুর করছে। তালা ভেঙ্গে তারা ঘরে ঢুকে। ফিরে এসে দেখি আলমারি ভেঙে টাকা পয়সা স্বর্ণালংকার যা ছিল সব নিয়ে গেছে। দেড় ঘণ্টার মতো প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তাণ্ডব চালায় হামলাকারীরা এবং এ সময়ে তাদের সহায়তার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। ঘরে ঘরে ঢুকে চেয়ার টেবিল আলমারি ভেঙ্গেছে তারা। যার ঘরে যা পেয়েছে তাই নিয়ে গেছে বা ভাংচুর করেছে।’
এসময় তাদের সাথে বাঁধে বহু নারী ও কিশোরী আশ্রয় নিয়েছিল বলেও তিনি জানিয়েছেন।
মূল ঘটনা কী
হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একজন হিন্দু ব্যক্তির স্ট্যাটাস দেয়ার জের ধরে শত শত হেফাজত সমর্থক বুধবার নোয়াগাঁও গ্রামে ওই হামলা চালায় বলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক বলছেন, সোমবার পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলায় একটি ধর্মীয় সমাবেশে বক্তব্য দেন হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী এবং আরেকজন নেতা মামুনুল হক।
এই সমাবেশের পরদিন নোয়াগাঁও গ্রামের একজন হিন্দু যুবক মামুনুল হককে নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই স্ট্যাটাসের প্রতিবাদ জানিয়ে স্থানীয় হেফাজতে ইসলাম মঙ্গলবার বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
রাতেই অভিযুক্ত যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং বুধবার সকালে আদালতে তাকে চালান দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও ওই যুবকের গ্রামটিতে হামলা চালানো হলো। এই হামলার ঘটনা তদন্ত করে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এখনকার পরিস্থিতি কেমন
এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে একজন স্থানীয় সাংবাদিক বলছেন, গ্রামটির চার থেকে পাঁচশ ঘরবাড়িতে ভাংচুর, লুটপাট চালিয়েছে হামলাকারীরা। এ ঘটনায় কোন হতাহতের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
জেলা প্রশাসক বলেন, আক্রমণ চলাকালে আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল গ্রামবাসীরা। পুলিশ ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এরপর ফিরে আসে গ্রামবাসীরা।
সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, প্রশাসনের কর্মকর্তারাও সেখানে গেছেন। কিন্তু এরপরও সেখানে মানুষের মাঝে আতঙ্ক কাটেনি বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি।
হেফাজতে ইসলাম কী বলছে
এই হামলায় হেফাজতে ইসলামের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও সংগঠনটির স্থানীয় নেতারা হামলার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
একই সূর দলটির কেন্দ্রীয় মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদীর মুখেও। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এটি একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা। এর সাথে হেফাজতকে জড়িত করা আমি ভালো মনে করি না। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার পরিকল্পনা হেফাজতের কখনো ছিল না এবং নেই।