দিল্লি থেকে :শুভজ্যোতি ঘোষ
রিপোর্টটি সম্পাদনা করেছেন :জিয়াউদ্দিন চৌ: ( জেড সেলিম)
দিল্লির কৃষক বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে একজন পরিবেশকর্মীকে গ্রেফতারের পর তা ভারতে তীব্র ক্ষোভ-প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে।অনেকেই একে আখ্যায়িত করেছেন ‘বাকস্বাধীনতার ওপর আক্রমণ’ হিসেবে।
বাইশ বছর বয়স্ক পরিবেশকর্মী দিশা রাভির বিরুদ্ধে অভিযোগ : ভারতের নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে গত তিন মাস ধরে বিক্ষোভরত কৃষকদের সহায়তার উদ্দেশ্যে একটি দলিল তৈরি এবং বিতরণ করেছেন তিনি।
পুলিশ বলছে, ‘প্রটেস্ট টুলকিট’ নামে পরিচিতি পাওয়া ওই দলিলটি তৈরি এবং বিতরণের পেছনের “মূল ষড়যন্ত্রকারীদের” অন্যতম হচ্ছেন দিশা রাভি।পুলিশ আরো বলছে, ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ নামে জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী আন্দোলনের ভারতীয় শাখার একজন প্রতিষ্ঠাতা হলেন এই দিশা রাভি,এবং তিনি ওই দলিলটি সম্পাদনা করেছেন এবং সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গের সাথে তা শেয়ারও করেছেন।
কিন্তু মিজ রাভি বলছেন, “আমি ওই টুলকিট তৈরি করিনি।আমরা শুধু কৃষকদের সমর্থন দিতে চেয়েছিলাম।আমি গত ৩ ফেব্রুয়ারি (দলিলটির) দুটি লাইন সম্পাদনা করেছি।” ভারতীয় নিউজ ওয়েবসাইট এনডিটিভি তাকে উদ্ধৃত করে এ বার্তা প্রচার করেছে।ভারতের কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গ্রেটা থুনবার্গ সেই টুলকিট টুইট করার পর তা ব্যাপক প্রচার পায়।
ভারতের আন্দোলনরত কৃষকদের প্রতি যারা সমর্থন জানাতে চান – তাদের কি করতে হবে তার নির্দেশিকা আছে ওই দলিলে।বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, এই টুলকিটের একাধিক সংস্করণ অনলাইনে ছড়িয়েছে, একটি বড় ও আরেকটি সংক্ষিপ্ত।এতে কীভাবে বিক্ষোভের আয়োজন করতে হবে, কীভাবে অনলাইনে প্রচারাভিযান চালাতে হবে তার প্রাথমিক পরামর্শ বা ‘টিপস’ আছে, আছে কিছু হ্যাশট্যাগ,আর আছে কিভাবে পিটিশনে স্বাক্ষর দিতে হবে – এসব নিয়ে পরামর্শ।
এতে ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে আগ্রহীদের কীভাবে ‘টুইটারে ঝড়’ তুলতে হবে, কীভাবে যে যেখানে আছেন তার নিকটস্থ ভারতীয় দূতাবাস বা অন্য কোন ভবনের সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করতে হবে – এসব পরামর্শও ছিল।অন্যদিকে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি বলছে,ভারতের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য যে “আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা” হচ্ছে – তারই প্রমাণ ওই টুলকিট।
ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ দিল্লি পুলিশের এক টুইটে বলা হয়, “২৬শে জানুয়ারির সহিংসতার পেছনে যে একটা ষড়যন্ত্র ছিল,তা হুবহু বাস্তবায়ন করা হয়েছে ওই টুলকিট অনুযায়ী” – এমন আভাস পেয়েছেন তারা।বলা হয়, গ্রেটা থুনবার্গের টুইটের পরই দিল্লি পুলিশ এই ‘টুলকিটের’ অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, এবং তাদের ভাষ্যমতে এই টুলকিট তৈরি করেছে খালিস্তান-পন্থী একটি সংগঠন।
গত সপ্তাহে ভারতে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে পপ তারকা রিয়ানা ও গ্রেটা থুনবার্গ টুইট করেন। গ্রেটা থুনবার্গ সেই টুলকিট টুইট করেও পরে তা আবার নিজেই মুছে দেন।এর পর এই টুলকিটকে কেন্দ্র করে মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটারের সঙ্গে ভারত সরকারের সংঘাত চরমে পৌঁছায়। টুইটারে প্রায় বারোশো’ অ্যাকাউন্ট ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করে ভারত-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে’, এই অভিযোগে ভারত সরকার সেগুলো পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি জানায়। তবে টুইটার এ চিঠির পর এখনও পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি।
ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দাদিশা রাভিকে সেখান থেকে উড়িয়ে এনে দিল্লির একটি আদালতে হাজির করা হয়।এর পর তাকে পাঁচ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।আদালতে শুনানির সময় তাকে কোন আইনজীবীও দেয়া হযনি।তাকে ঠিক কি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে তা-ও স্পষ্ট নয়।
অনেকে আশংকা করছেন, তাকে ঔপনিবেশিক যুগের একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনে আটক রাখা হয়েছে – যা সম্প্রতি বেশ কিছু সাংবাদিককে গ্রেফতার করতে ব্যবহার করা হয়। দিশা রাভিকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনলাইনে সরব হয়েছেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি,এ্যাকটিভিস্ট, সাংবাদিক, বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ যাদের মধ্যে আছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমও ।
এদিকে ভারতের তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন স্থগিত রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে ভারতের শীর্ষ আদালত। এই আইনগুলো বাতিল করার দাবিকে কেন্দ্র করেই দিল্লির সীমান্তে গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে তীব্র কৃষক আন্দোলন চলছে।এই তিনটি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে করা এক মামলার শুনানিতে দেশের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবডে সরকারের উদ্দেশ্যে সোমবার রীতিমতো হুঁশিয়ারির সুরে মন্তব্য করেছেন, “আপনারা এই আইন স্থগিত করবেন কি না জানান, নইলে আমরাই সেটা করতে বাধ্য হব।”কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে পুরো বিষয়টি সামলাচ্ছে, তাতে সুপ্রিম কোর্ট যে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ বিচারপতিরা সেটাও গোপন করেননি।
কেন্দ্রের পক্ষ থেকে কৃষক আন্দোলনের নিষ্পত্তি করার জন্য আরও সময় চাওয়া হলে বিচারপতি বোবডে সরাসরি বলেন, “আমাদের আদৌ মনে হচ্ছে না সরকার ঠিকমতো বিষয়টা সামলাতে পারছে।এখন কৃষক আন্দোলনকে ঘিরে রক্ত ঝরলে আপনারা কি দায় নিতে প্রস্তুত?” তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন করার আগে সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা করেনি বলেও সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছে।
কেন্দ্রের পক্ষ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে ভেনুগোপাল প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে রায় দেওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো কেন?
জবাবে প্রধান বিচারপতি তাকে বলেন, “আমাদের ধৈর্য নিয়ে কোনও জ্ঞান দিতে আসবেন না। এতদিন আমরা আপনাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছি,আপনারা কিছুই করতে পারেননি।” তবে আজকের রায়ের পরও কৃষকদের তাদের আন্দোলন চালানোর অধিকার থাকবে, শীর্ষ আদালত সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছে।”কিন্তু আপনারা যেখানে অবস্থান নিয়ে আছেন সেখানেই থাকবেন না কি অন্য কোথাও গিয়ে আন্দোলন করবেন সেটা আপনাদেরই স্থির করতে হবে”, কৃষকদের উদ্দেশে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট।মামলার শুনানির সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম কোর্ট একটি কমিটি গড়ে দিতে পারে – কিন্তু আইনগুলোর বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা ঠিক হবে না।
সূএ:বিবিসি