প্লেটোনিক ভালোবাসা বা বায়বীয় ভালোবাসা হলো সেই শুদ্ধতম ভালোবাসা যাতে কামনা বাসনার কোনও স্থান নেই। এ শব্দটির উৎপত্তি মূলত প্লেটোর “প্লেটোনিজম” মতবাদ থেকে যাতে বলা হয় এমন প্রকার ভালোবাসার কথা যাতে প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোবাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রবেশ করবে কিন্তু শরীর নামক বস্তুটি থাকবে অনুপস্থিত।যে প্রেমে শরীর বিষয়টি অনুপস্থিত অথচ প্রেমের স্বাদ বা রস আস্বাদন করা যায় ষোলো আনা, এমন প্রেমই একমাত্র প্লেটোনিক প্রেম বা বায়বীয় ভালোবাসা হিসেবে পরিগণিত হবে। এ ভালোবাসা কামগন্ধহীন, কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয় পরিবর্তে নেয় না কিছুই। এমন নিষ্কাম প্রেম, যে প্রেম রাজাধিরাজের মতো দু’হাত ভ’রে শুধু দিয়ে যায়, নেয় না কিছুই। যাকে লাভ করার জন্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর দুঃসহ যন্ত্রণাসমূহও সহ্য করতে হয় মুখ বুজে। বিনিময়ে কখনও কখনও কপালে জোটে ব্যর্থ প্রেমিকের অপবাদের ছাপ! প্রেমের জন্য স্বেচ্ছায় নিজের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়-প্রেমের এমন ভয়ঙ্কর রূপের নামই তো প্লেটোনিক লাভ! যেখানে প্রেমিকের শরীরের গন্ধই প্রেমিকাকে মোহিত করার জন্য যথেষ্ট তার উপস্থিতির দরকার পড়ে না। এরূপ ভালবাসায় থাকে না কোনও চাহিদা, থাকে কেবল অনন্ত ভালোবাসা। যৌনতার কোনও স্থান নেই প্লেটোনিক ভালোবাসায়। এ প্রেম ভালোবাসার সর্ব্বোচ পর্যায়। এ এক প্রচণ্ড ভালোবাসা যখন প্রেম কে মনে হয় স্বর্গ সুখ।
প্লেটোনিক প্রেমঃ যে পৃথিবীতে আছে, পাত্রশালা, সেই পৃথিবীতে আছে দেবগুহও। তাইযে হৃদয়ে ফোটে দেহ দু- প্রেমের কামনাপুষ্প সেখনেই ফোটে দেহাতীত প্রনয়ের স্বর্গীয় খোরকও। যে পারে সে এমনি পারে। পারে সে ফুল ফোটাতে। দিন যাপনের প্রান ধারনের গ্লানি থেকে, সব কলুষের সংক্রমন থেকে এই প্রেমকে সরিয়ে রাখা যায়কি? কতদিন বেচে থাকে এর সৌরভ? প্লেটোনিক প্রেম কি আসলেই বিষাসন্ত এক কাহিনী ? নাকি বেদনার বৃত্তে ফুটে ওঠা এক মধুর প্রাপ্তি?
ভালবাসার চিরতরিৎ বনের বানর হরিন। আর যে ভালবাসা কাম গন্ধহীন? সে তো দুষ্প্রাপ্য বিদেশি ফুলের চারা। একই সঙ্গে মনোলোভন আর ক্ষনজীবি। কাজুনোদামের কালির মতো চাদেও আলোর টুকরো যখন আমার বিছানায় এসে পড়ে চিনারের বনে যখন আকালের ঝড়ো হাওয়া পাগল হয়ে ওঠে/ তখন তোমাকে মনে পড়ে আমার / তোমাকে মনে পড়ে/ তোমার নাম যে আমার মনে আনতেও মানা। এরই নাম নিস্কাশ প্রেম, যে প্রেম রাজাধিরাজের মতো দুহাত ভরে শুধু দিয়ে যায়। নেয়না কিছুই।। ইরানি এই গজলটিতে প্রেমপীড়িতা যে মেয়েটির হাহাকার শোনা যাচ্ছে, ঠিক তারই মতো নিস্কাম প্রেমকে নিজের জীবনে দেবী পেতে বসানোর সুযোগ হয় না। অনেকেরই। আটপৌওে প্রাত্যহিকতাম ডুবতে ডুবতে আর ভাগতে ভাগতে অনেক দুরে চলে যেতে হয় অমর এই প্রেমের কুল ছেড়ে। ৪৮২ খৃষ্টপূবাদ্ধে সেক্রেটিসের সে প্রিয় শিক্ষাটি উন্মান তার নার প্লেচৌ। দেহলেশহীন। ভলবাসার সঙ্গে এই প্লেটোর নাম বাড়িয়ে গেছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। প্লেটোর মতবাদ প্লেটোনিজম থেকেই এই প্রেমের নাম হয়েছিল প্লেটোনিকলাজ তার মনে কি এই যে সুদুর সময়ের এই গ্রীক পন্ডিতই প্রথম ভালবাসা থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন শরীরকে ? আর এর বিপরীত জ্ঞান না নেই দিতে চেয়েছিলেন তত্ত্বরাপ? এটা ঠিক তা নয় তবে প্লেটোর দর্শনের একাংশে অধক্ষই গাওয়া হয়েছে শরীর মিহীন প্রেমের জয়গান। কিন্তু সেটা ঠিক মানষী প্রেমের তত্ত্বস্থাপনা নয়। প্লেটোর দর্শনে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে যা আলোকসামান্য। ইন্দ্রিয়াতীত প্রেমের সঙ্গে তার সংক্ষিপ্ত বাদই মানুষের চিরসন্ধিৎসার বিষয় কিন্তু এই ব্যাপক উচ্চর্সাগী প্রেম ও সৌন্দর্যকে বোঝাবার জন্যই মানুষকে লৌকিক প্রেমে অবগহন করতে হয়। আর তখনই তার ভিতরে জেগে উঠতে থাকে পারমর্থিক আকাশে ওড়ার ডানা। তখন ইন্দ্রিয়ের ছোট ডান্ডি ছেড়ে সমস্ত ক্লেদপন্ধ ঝেড়ে, তার উড়ান শুরু হয় অতীন্দ্রিয়তার দিকে, বোঝা কঠিন নয়, এই ভাবনাই যুগিয়েছে নিষ্কাস প্রেম সম্পর্কিত ধারনার প্রথম সিড়িটি। তাই রবীন্দ্র ভাবনায় পাওয়া গেছে তার প্রস্ফুটন, লোভের অতীত যথা, সুন্দর যা, অনিবচনীয় যাহা ক্রিয়। অর্থাৎ ভালবাসা অর সুন্দর একই ফিল বিন্দুতে মিলেছে, কিন্তু সেখানে লোভের ছোয়া নেই। আছে অনির্বচনীয়তা। এখানে লোভ মানে অবশ্য গ্রিড নয় এরটিসিজম। তবু একথা কখনোই বলা যাবেনা, ধারনাটি একেবারেই ধার করা, বিদেশী। এর শিকড় আছে এদেশেও। প্লেটোর অতীন্ত্রিয় প্রেমতত্ত্ব যদি রবীন্দ্র ভারনায় বীজের কাজ করে থাকে, তবে সারের কাজ করেছে প্রাট্য দর্শন আর বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্ব ও । বৈষ্ণব পর্দকার চন্ডীদাসের সঙ্গে রামীরজাকিনীর প্রেমের কথা সকলেই মানেন। সমাজ এই অসম প্রনয়কে রক্ত চোখ দেেিয় উৎপীড়িত করেছি, তাই প্রেমিক চন্ডীদাসের কলমে ঝরেছিল রক্ত, রজকিনী প্রেম/ নিকষিত হেম/ কামগন্ধ নাহিতায় এই বুঝি ইন্দ্রয়হীন প্রেমের চিরকালীন সমানিফেস্টো ব্যক্তিজীবন এমন ব্যাথাসুরভিত প্রেমের কাহিনী ছিল বলেই বুলি চন্ডীদাসের পদে প্রতি ছত্রে ফুটে উঠেছে রাধার নিষ্পাপ প্রেমের অশ্র“শিশির কনা, আর পদাবলীর পদ যাকে নিয়ে, সেই বৃষ্ণের তুলনায় চন্ডীদাস ও অনেক অর্বাচীন। প্লেটোর সঙ্গে সময়ের বাজিতে নিঃসন্দেহে জিতবেন কৃষ্ণ । প্রেমের তিনি নাকুর, প্রেমের তিনিই রাজা। রাধার সঙ্গে তার দরকারী প্রেম, রুক্সিনীর সঙ্গে স্বকীরা প্রেম। আর ইন্দ্রয়ধিরহিত প্রেম পান্ডবপতœী কৃষ্ণার সঙ্গে সখি পাঞ্চালীর জন্য কৃষ্ণের যে মধুর আবেগ, সে কি প্রেম নয়? ওই তন্মী ক্ষামা শিখরীদশনা পদ্ধদলাম নয়নী কি প্রেমিকোত্তম কৃষ্ণের শুধুই সখি? পুরান কাবের স্বরচিত ওই সস্বোধনের পদটুকু সরালেই স্পস্ট হয়ে ওঠে সত্যের স্বরুপ । স্ত্রী নয় প্রেমিকা নয়, এমন সে নারী পার্বতী , ইন্দ্রিয়ের নাগালে যাকে কখনওই পাওয়া যাবেনা, তার জন্যে কৃষ্ণের মতো পুরুষ শ্রেষ্টের এতখানি ভাললাগা, বিষ্ময় আর সম্ভ্রমকে অন্তরঙ্গতা ও সমিদার এমন সংক্ষিপ্তকে আর কী আশা দেওয়া সম্ভব? অন্যদিকে ভূয়সী গুনের আধার পঞ্চপতি থাকা সত্তেও একান্ত বিপদে, জটিলতম সমস্যায় দ্রৌপদিও মতো আত্ম সম্মান বোধ সম্মন্ন , তেজাস্ত্রিনী রমনী বুলোওমা, যাকে বার বার নির্ভও করতে চেয়েছেন, পেতে চেয়েছেন বিপদে সম্পর্কে যার সান্বিধ্যে তিনি শুধুই সখী হতে পারেনা সম্ভবত সাধারন মানুষের নৌককতা এমন নির্মল একটি সম্পর্ককে কখনও ভুল বোঝে, লেপে দেয় রুনন্ধ, তাই মহাভারত স্ত্রষ্টীকে সখ্য এই নিরাপদ নামের বর্ম পরাতে হয়েছিল এই সম্পর্ককে। বাস্তবিক এই সম্পর্ক যে ভোরের আনেরে মতো, মুখে ওঠা কুড়িটির মতো, যতটা অমলিন ঠিক ততটাই দুর্লভ। ঠিক ততখনই দুরাহ, প্রতিদিনের বহুব্যবহারের কলুষ থেকে ওকে বাচিয়ে রাখা। শরীর প্রনবতা থাকে যে প্রেমে সে তো নিব্য ব্যবহারের বস্তু রবীন্দ্রনথের ভাষায় ঘড়ার দুল কোন এক কর্মহীন শূন্য অবকাশে। সব মিটিয়ে তাতে অবদাহন কওে নিতে হয়। তায়ই বেশ মঞ্জীজিত করে রাখে বানী জীবন যাপনকে।
অবশ্য এর বিরুদ্ধে যে মুক্তি ও যে নেই তা নয়। অনেকেই মতেই শরীরবিহীন প্রেম হল সোনার পাথর হাটি। অনেকে একথা প্রেম শেষে বাক নেয় বিকৃতির ঢালে । সাহিত্য এমন দৃষ্টান্ত একেবাওে নিরল নয়। ধরাবাধা চরিত্রহীনের কিরনময়ীর কথাই। উপীন্দ্রের প্রতি তার ভালবাসায় মলিন কিংবা নিসা ছিলনা। ছিলনা দখলদারির লোক। সতীর স্বামীর জেনেই উপীন্দ্রকে সে তার মনের মনিকোঠায় অভিসিক্ত করেছিল ।
প্লেটোনিক ভালোবাসা সম্পর্কে শিক্ষার্থী নিসা আল হাসান বলেন:
প্লেটোনিক ভালোবাসা বা বায়বীয় ভালোবাসা হ’ল সেই শুদ্ধতম ভালোবাসা যাতে কামনা বাসনার কোনও স্থান নেই।বায়বীয় প্রেমে শরীর লাগে না।সুপ্ত কাম বাসনাও থাকে না।কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, আছে শুধু হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা।প্রেমের জন্য স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে নিজের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়-প্রেমের এমন ভয়ঙ্কর রূপের নামই তো প্লেটোনিক লাভ! যেখানে প্রেমিকের শরীরের গন্ধই প্রেমিকাকে মোহিত করার জন্য যথেষ্ট তার উপস্থিতির দরকার পড়ে না।এরূপ ভালবাসায় থাকে না কোনও চাহিদা, থাকে কেবল অনন্ত ভালোবাসা।যৌনতার কোনও স্থান নেই প্লেটোনিক ভালোবাসায়।এ প্রেম ভালোবাসার সর্ব্বোচ পর্যায়।এ এক প্রচণ্ড ভালোবাসা যখন প্রেম কে মনে হয় স্বর্গ সুখ।প্লেটোর দর্শনের একাংশে অবশ্যই শরীরবিহীন এক অদৃশ্য প্রেমের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই প্রেম ঠিক মোটাদাগের প্রেমের তত্ত্বস্থাপনা নয়! তাই বিষয়টি সাধারণ চোখে শুধুমাত্র প্রেম বা ভালোবাসা বলে ধরা হলেও এর অভ্যন্তর বেশ জটিল আর বাইরের দেয়ালও নানা আবরণে আচ্ছাদিত।অর্থাৎ মন-মগজ আর শারীরিক প্রেমের পাশাপাশি যে প্রেমে শরীর বিষয়টি অনুপস্থিত অথচ প্রেমের স্বাদ বা রস আস্বাদন করা যায় ষোল আনা, প্লেটো ঠিক এমন এক প্রেমানুভূতিকে পৃথকভাবে যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।