দাঙ্গায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কড়া সমালোচনায় দিল্লির পুলিশ

শুক্রবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে উত্তরপূর্বাঞ্চলে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, দাঙ্গা আটকানোর জন্য যেমন পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নি, তেমনই দাঙ্গা পীড়িত মানুষ যখন ফোন করে পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন, তখনও তাদের একাংশকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নি।তাতে সহযেই প্রতীয়মান হয় যে,সেখানকার পুলিশও সামিল হয়েছিল।

এবছরের ২৩শে ফেব্রুয়ারি উত্তর পূর্ব দিল্লিতে যে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল, তাকে ভারতের রাজধানী শহরে সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ দাঙ্গা বলে মনে করা হয়।

ওই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন ৫০ জনেরও বেশি, যার মধ্যে বেশিরভাগই মুসলমান।

দাঙ্গায় পুলিশের ভূমিকা যে অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা ভিডিওতেই দেখা গিয়েছিল।

এখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শুক্রবার প্রকাশিত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদনে পুলিশের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছে।

তারা বলছে, সামাজিক মাধ্যমে দাঙ্গার যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, সেগুলি তাদের নিজস্ব পরীক্ষাগারে যাচাই করেছে, আবার ৫০ জনেরও বেশি দাঙ্গা পীড়িত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিডিও সাক্ষাতকার নিয়েছে।

যে ভিডিও সাক্ষাতকার তারা প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে একজন মিসেস কিশমাথুন। তিনি দাঙ্গায় নিহত যুবক ফৈজান নামের একজনের মা।

ফৈজান এবং তার কয়েকজন সঙ্গীর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল – যেখানে দেখা গিয়েছিল তারা কয়েকজন রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে আর জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের এবং কিছু মানুষের সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ কর্মী তাদের ক্রমাগত মেরে চলেছে লাঠি দিয়ে।ওই ভিডিওটি তোলার তিনদিন পরে ফৈজান মারা যায় বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

মিসেস কিশমাথুন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে তার ছেলেকে মারধর করার পরে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং ৩৬ ঘণ্টা কোনও অভিযোগ দায়ের না করেই আটক রেখেছিল।

দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে কী চিত্র উঠে এসেছে, সেটাই বলছিলেন ভারতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আইনি এবং নীতিগত বিষয়ের প্রধান মৃণাল শর্মা।

মিজ শর্মার কথায়, “ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোকসভায় ১১ই মার্চ বলেছিলেন যে দিল্লির দাঙ্গা থামাতে পুলিশ খুব ভাল ভূমিকা পালন করেছে, অথচ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে তদন্ত চালিয়েছে, তাতে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র উঠে এসেছে। পুলিশ যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, সেটাই আমরা জানতে পারছি।”

দিল্লির-রাস্তায়-পুলিশ-ও-বিক্ষোভকারীদের-মধ্যে-সংঘর্ষ।

“কোথাও যেমন জানা গেছে যে ঘটনাস্থলে হাজির থাকা সত্ত্বেও পুলিশ দাঙ্গাকারীদের আটকানোর চেষ্টা করে নি, কোনও ঘটনায় জানা গেছে যে অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছে। অথচ তাদের আবার দেখা গেছে এনআরসি-সিএএ বিরোধী প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার করতে। অনেককে গ্রেপ্তার করে আদালতে না তুলেও আইন ভেঙ্গেছে দিল্লি পুলিশের একাংশ। আটককৃতদের বেশিরভাগই মুসলমান – এটাও জানা গেছে,”বলছিলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মৃণাল শর্মা।

সামাজিক মাধ্যমে দিল্লি দাঙ্গার যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, তারই একটা ছিল পুলিশ দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে মিলে পাথর ছুঁড়ছে।

ওই ভিডিওর সত্যতা বিবিসি যাচাই করে দেখেছিল।দাঙ্গা এবং তার পরবর্তী সময়ে উত্তরপূর্ব দিল্লির নানা এলাকায় ঘুরে খবর যোগাড় করেছেন বিবিসির হিন্দি বিভাগের সাংবাদিক কীর্তি দুবে।

তিনি বলছিলেন,”বিবিসি একটা ভিডিওর সত্যতা যাচাই করে দেখেছে, যেখানে দাঙ্গাকারী আর পুলিশ একসঙ্গে মিলে পাথর ছুঁড়ছে। ওই ভিডিওটা ছাড়াও উত্তর-পূর্ব দিল্লির নানা এলাকায় যখন আমি ঘুরেছি, দাঙ্গা পীড়িতদের সঙ্গে, বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারাও আমার কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছে।”

এর মধ্যে যেমন আছে, দাঙ্গার সময়ে পুলিশ কন্ট্রোলে ফোন করে সাড়া না পাওয়া আবার তেমনি আছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ বিশেষ কোনও ভূমিকা না নেয়া, বলছিলেন কীর্তি দুবে।

বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে অবশ্য দিল্লি পুলিশের এক মুখপাত্র সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, কোনও পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে যদি এধরণের অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই তদন্ত করা হবে।

কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ছ’মাস পেরিয়ে গেলেও দাঙ্গার সময়ে দিল্লি পুলিশের কী ভূমিকা ছিল, তার একটিরও তদন্ত হয় নি।

এই-সংঘর্ষে-প্রতিবাদকারীদের-ধর্মীয়-পরিচয়ের-ভিত্তিতে-আলাদা-হতে-দেখা-যায়।

তারা বলছে, দাঙ্গার ঘটনাগুলিতে ৭৫০টিরও বেশি এফআইআর করেছে, ২০০-র বেশি চার্জশীট জমা দিয়েছে, কিন্তু পুলিশের ভূমিকা নিয়ে একটি মামলাও রুজু হয় নি বা কোনও তদন্তও হয় নি বলে জানাচ্ছে অ্যামনেস্টি।

মৃণাল শর্মার কথায়, “এর থেকেই বোঝা যায় যে দিল্লি পুলিশের যে ভূমিকা ছিল, তার পিছনে সরকারি মদত রয়েছে। আমরা চাই পুলিশের ভূমিকার একটা নিরপেক্ষ তদন্ত। তাতে যেমন নাগরিক সমাজের সদস্যরা থাকতে পারেন তেমনই বিচারকরাও থাকতে পারেন। এই তদন্ত কমিটিকে এমন ক্ষমতা দেওয়া উচিত, যাতে তারা আইন মোতাবেক কাউকে শমন পাঠিয়ে সাক্ষ্য দিতে ডাকতে পারে। কিন্তু তাতে দিল্লি পুলিশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে রাখা চলবে না।”

দাঙ্গার নেপথ্যে

বিতর্কিত নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়।নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশকারী অমুসলিমদের নাগরিক হওয়ার অনুমতি দেয়।

হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকার বলছে, এর ফলে ভারত ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা মানুষের অভয়াশ্রমে পরিণত হবে।সমালোচকরা বলছেন, এই বিলটি মুসলমানদের একঘরে করতে বিজেপি এজেন্ডার একটি অংশ। গত বছর এটি পাস হওয়ার পরে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয় এবং এর মধ্যে কয়েকটি বিক্ষোভ সহিংস আকার নেয়।তবে দিল্লিতে এখন পর্যন্ত হওয়া সব বিক্ষোভই ছিল শান্তিপূর্ণ।

দিল্লিতে-বিজেপির-বিতর্কিত-নেতা-কপিল-মিশ্রা.

রাজধানীর কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব দিল্লির তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছিল তাদের অবরোধের বিরুদ্ধে এক কিলোমিটার ব্যবধানে পাল্টা বিক্ষোভ করে এই আইনের সমর্থকরা।এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়।

এরসঙ্গে বিজেপির এক নেতা কপিল মিশ্র যুক্ত বলে জানা গেছে, যিনি নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী অবস্থান নেয়া বিক্ষোভকারীদের হুমকি দিয়েছেন, তাদের বলেছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত ছাড়ার পরে তাদের জোর করে উচ্ছেদ করা হবে।মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার প্রথম আনুষ্ঠানিক সফরে ২৪ থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ভারতে অবস্থান করেন।

জাফরাবাদের-একটি-বাড়ির-বৈঠকঘরে-আশ্রয়-নিয়েছেন-কয়েকশ-মুসলিম-নারী-পুরুষ-শিশু.

সহিংস দাঙ্গাকারীরা মুসলমানদের বাড়িঘর ও দোকানপাট লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।আরেকটি মসজিদ ভাঙচুর হয়। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিও ফুটেজে মসজিদের মিনারের শীর্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে চাঁদ তারা সম্বলিত ক্রিসেন্ট চিহ্নটি টেনে তুলে ফেলতে দেখা যায়।

ধারণা করা হয়, সেখানে হিন্দু মুসলমান উভয়ই রয়েছে। ওইসব হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ।গুলিবিদ্ধ ক্ষতসহ বিভিন্ন ধরণের আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভিড় করতে দেখা গেছে।

আহতদের মধ্যে অনেকে “বাড়ি ফিরে যেতে খুব ভয় পাচ্ছিল।”প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দাঙ্গায় অংশ নেয়া বেশ কয়েকজনকে হাতে বন্দুক বহন করতে দেখা যায়। এবং ছাদ থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে খবর পাওয়া গেছে।হাসপাতালের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন যে আহতদের অনেকের শরীরেই গুলির ক্ষত রয়েছে।

দাঙ্গায় বিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লির একটি এলাকা

তবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি তাদের ছিল না। এবং তারা সংখ্যায় ছিলেন অনেক কম।সহিংসতায় রতন লাল নামে এক কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ।

দিল্লির পুলিশ বাহিনী, রাজ্য প্রশাসনের পরিবর্তে মি. মোদীর ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে সরাসরি সব তথ্য জানিয়েছিলো।উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সাথে দিল্লির যে সীমান্তের ভাগ রয়েছে – এই অঞ্চলগুলো তার কাছাকাছি এবং এই সীমান্ত আটকে দেওয়া হয়েছিলো।এলাকার স্কুলগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি এবং বেশ কয়েকটি এলাকায় জনসমাগমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।