করোনাভাইরাস টিকা পরীক্ষা করার পেছনে ও রাজনীতি

অক্সফোর্ড যদি ভারতকে অনুমোদন দেয় বিক্রি করতে, তাহলে তারা বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে। এটা নির্ভর করছে অক্সফোর্ডের ওই কোম্পানি এবং ভারতের মধ্যে কী দেন-দরবার হয়েছে, সেটার ওপর। চীন যদি চায় তাদের ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশকে নিতে হবে। তাহলে চীন বাংলাদেশর ওপর চাপ দেবে।কারন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চীন পদ্মা সেতু বা তিস্তা সেতুর অর্থায়নের শর্ত তুলে চাপ দেবে। বাংলাদেশের উচিত এখনই হেলথ ডিপ্লোম্যাসি শুরু করা।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিনের পেটেন্ট নিয়ে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে এবং এই ভ্যাকসিনটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, তার দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে।ভারত তাদের উৎপাদিত টিকা বাংলাদেশকে দেবে কি না সেটা দেশটির নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।

কিন্তু ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন বাংলাদেশ কোন্ উপায় পাবে সেটা ভারতের সাথে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চুক্তির ওপর নির্ভর করবে বলে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ ফ ম রুহুল হক।

তিনি বলেন, “ভারতসহ বিভিন্ন দেশকে অক্সফোর্ড এই টিকা উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে। অক্সফোর্ড যদি ভারতকে অনুমোদন দেয় বিক্রি করতে, তাহলে তারা বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে। এটা নির্ভর করছে অক্সফোর্ডের ওই কোম্পানি এবং ভারতের মধ্যে কী দেন-দরবার হয়েছে, সেটার ওপর।”

যেহেতু, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তাই মি. হক আশা করছেন যে ওই টিকা বাংলাদেশকে দেয়ার মতো অনুমোদন তাদের আছে।

“পররাষ্ট্র সচিবের মতো শীর্ষ পর্যায়ের নেতার কিছু বলা মানে সেটা ভারত সরকারের বক্তব্য। এতে ধারণা করাই যায় যে, ওই টিকা সফল হলে সেটা বাংলাদেশকে দেয়ার অথরিটি তাদের আছে,” বলেন সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ও চীন সাতটি দেশে ভ্যাকসিনের অ্যাডভান্সড ট্রায়াল শুরু করেছে। এগুলোর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বাংলাদেশে শুরু করা উচিৎ বলে অভিমত দিয়েছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি।সে লক্ষ্যে টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব।

এখন বাংলাদেশে কোন টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হলে কী লাভ হবে, সে বিষয়ে সরকারের ভ্যাকসিন বিষয়ক কমিটির সদস্য ডাঃ শামসুল হক বলেন: “কোন দেশে ভ্যাকসিন পরীক্ষার পর যদি এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায় তাহলে যে দেশে পরীক্ষা চালানো হয়েছে, সেখানে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সহজ হয়ে যায়। ”আবার যারা এই ভ্যাকসিন উৎপাদক তারা যেসব দেশে পরীক্ষা চালায় তাদেরকে সাধারণত অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে,” জানান ডা: হক।

এর আগে চীন মোট ছয়টি দেশে তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করে। দেশগুলো হল ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ফিলিপিন্স ও তুরস্ক।বাংলাদেশেও এই টিকার ট্রায়াল হওয়ার কথা থাকলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা জানালে সেই প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়।

অথচ জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং বাংলাদেশ মেডিকেল গবেষণা পরিষদ এই ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতিও নিয়েছিল। এরপরেও সেটা বাংলাদেশে কেন পরীক্ষা করা হয়নি সেটা নিয়ে সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীন যদি চায় তাদের ভ্যাকসিনটি কোন দেশকে নিতে হবে। তাহলে চীন ওই দেশের ওপর চাপ দেবে।মি. আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চীন পদ্মা সেতু বা তিস্তা সেতুর অর্থায়নের শর্ত তুলে চাপ দেবে। এই ঘোষণা দেয়ার দুইদিনের মাথায় মি. শ্রিংলা ঢাকায় হাজির হয়েছেন।

তাই চীনের টিকা পরীক্ষা না করার পেছনে যে রাজনীতি নেই, ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই এটা উড়িয়ে দেয়া যাবে না বলে জানান মি. আহমেদ।তিনি বলেন, “যখন বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে একজন মন্ত্রী টিকার মতো বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে সেটা কোন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত থাকে না বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।”

সাধারণত বাজারে আসা প্রথম ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিতরণ করে থাকে।যেসব দেশের মাথাপিছু আয় কম তাদেরকে বিনা মূল্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়। তবে এই প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ হওয়ায় বিভিন্ন দেশের সরকার ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আগে থেকেই চুক্তি করে বা অগ্রিম অর্থ দিয়ে রাখে।

কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কারও সাথে ট্রায়ালের অংশীদার হওয়ার কোন চুক্তি করেনি , ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতে অগ্রিম অর্থও দেয়নি।এমন অবস্থায় সরকারের করণীয় সম্পর্কে মি. আহমেদ বলেন, “যখন ভ্যাকসিন বাজারে আসবে, তখন রাজনীতির খেলাগুলো বোঝা যাবে। বাংলাদেশকে সেটা হ্যান্ডেল করতে গেলে প্রচুর হোমওয়ার্ক করতে হবে। বাংলাদেশ এখনও হেলথ ডিপ্লোম্যাসি শুরু করেনি।”

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিষেধক নিয়ে যতো বক্তব্য আসছে তার সবই রাজনৈতিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক কথা দিয়ে টিকার মতো বৈজ্ঞানিক বিষয়ে সফল সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। সুতরাং এখানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিতে হবে।” বাংলাদেশ যদি সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে ভালো দেন-দরবার করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। ভুক্তভোগী হবে না বলে জানান মি. আহমেদ।

এদিকে কোন্ দেশ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে এগিয়ে গেছে, কাদের ভ্যাকসিনের মান ভালো, কার্যকরী এবং দামে সাশ্রয়ী এমন নানা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাসের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়ে চুক্তি করবে বলে জানিয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক।এছাড়া অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে টিকা পাওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

তবে বাংলাদেশের মতো বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে যে পরিমাণ অর্থ অগ্রিম করা প্রয়োজন, সেটা দেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বেনজির আহমেদ।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বাস্থ্য অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন।এরি মধ্যে রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে টিকা উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন টিকার অনুমোদন দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।কবে নাগাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিয়ে কোন ভ্যাকসিন বাজারে আসতে পারে সেটা বলা যাচ্ছে না।

এদিকে যেসব দেশের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সক্ষমতা নেই অথবা ক্রয় ক্ষমতাও যাদের সীমিত তাদের ক্ষেত্রে যাতে বৈষম্য তৈরি না হয়, ভ্যাকসিন শুধু অর্থ ক্ষমতার বিষয় হয়ে না দাঁড়ায় – সেজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৯০টি দেশের একটি তালিকা তৈরি করেছে।যারা বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পাবে – বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে।এক্ষেত্রে কোন দেশের মাথাপিছু আয় কত সেটি বিবেচনা করা হয়েছে এবং এই ভ্যাকসিন দেয়া হবে একটি দেশের চাহিদা অনুযায়ী।