মিঠাপানির স্থায়ী বাসিন্দায় বঙ্গোপসাগরের ইলিশ

ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের অর্থায়নে করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বহু ইলিশ ডিম পাড়তে গঙ্গায় ঢুকলেও আর কখনও বঙ্গোপসাগরে ফিরছে না। এদিকে ২০১৭ সালে ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মেধা-স্বত্ব কর্তৃপক্ষ।২০১৮ সালে এই মাছটির পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচনের কৃতিত্ব অর্জন করলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।

ভারতের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে বহু ইলিশই আর কখনও সাগরে ফিরে যাচ্ছে না।

ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা “প্রিয়দেশ নিউজ”কে জানিয়েছেন, ঠিক এই কারণেই এখন গঙ্গার মোহনা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার উজানেও সারা বছর ধরে ইলিশ মিলছে – এবং স্বাদে-গন্ধেও সেগুলো দারুণ ভাল।

মোহনায় পাতা মাছধরা জালের ভয়েই ইলিশের ঝাঁক মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের ইলিশ কেন আর কীভাবে মিঠাপানির স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হচ্ছে?

ইলিশ সাগরের মাছ হলেও ডিম পাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নদীতে ঢোকে – আবহমান কাল থেকে ইলিশ-প্রিয় বাঙালি সেটাই জেনে এসেছে।

কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের অর্থায়নে করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বহু ইলিশ ডিম পাড়তে গঙ্গায় ঢুকলেও আর কখনও বঙ্গোপসাগরে ফিরছে না।

ওই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী, অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ বলছিলেন, ইলিশের ‘অটোলিথে’ বিভিন্ন রাসায়নিকের পরিমাণে তারতম্য দেখে তারা এর প্রমাণ পেয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, “অটোলিথ মাছের একটা অর্গ্যান, যা ইলিশের ক্ষেত্রে মাথায় থাকে, কোনও কোনও মাছের ফ্যারিঞ্জিয়াল রিজিওনেও থাকে। এই অটোলিথ বিশ্লেষণ করে একটা মাছের মাইগ্রেটরি রুট সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।

“আমরা এখন ইলিশের অটোলিথ কেটে দেখতে পাচ্ছি সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিকের অনুপাত এমন যা থেকে স্পষ্ট অনেক ইলিশই আর সাগরে ফিরছে না। মিঠা জলে এগুলোর বেশ ওজনও হয়ে গেছে – পাঁচশো বা সাড়ে পাঁচশো গ্রাম – আবার ওদিকে ক্ষুদে সাইজের পাঁচ-দশ গ্রাম ওজনের ইলিশও মিলছে।”

আসলে সাগরে না-ফেরাটা এই ইলিশগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার চেষ্টা বা ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বলেই মনে করছেন ভারতের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশনের মুখ্য বিজ্ঞানী বি কে মহাপাত্র।

“গলদা চিংড়ি হরিদ্বারেও দেখা যায়, সেখান থেকে ডিম পাড়তে তারা চলে আসে সুন্দরবনের মোহনাও। এই জাতীয় মাছকে বলে ক্যাটাড্রোমাস। কিন্তু ইলিশ হল অ্যানাড্রোমাস মাছ, তারা সাগর থেকে ডিম পাড়তে যায় নদীর ভেতর।”

“কিন্তু কেন এখন তারা আর ফিরতে চাইছে না? চাইছে না, কারণ গঙ্গার এসচুয়ারি জুড়ে বিছানো আছে চোদ্দ হাজারেরও বেশি জাল – তাই প্রাণে বাঁচতেই তারা রয়ে যাচ্ছে মিষ্টি জলে। এটাকে বিবর্তনবাদ বা ন্যাচারাল সিলেকশন হিসেবেই দেখা যায়,” বলছিলেন বি কে মহাপাত্র।

বহু বছর আগে গুজরাটে দেখা গিয়েছিল, তাপ্তী নদী বেয়ে ইলিশের ঝাঁক উকাই জলাধারে ঢুকে সেখানেই থাকতে শুরু করে, ডিম পাড়ে ও তাদের বাচ্চাও হয়।

এখন অনেকটা একই ধাঁচের জিনিস দেখা যাচ্ছে গঙ্গাতেও – জানাচ্ছেন অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ।

“গঙ্গায় কাকদ্বীপের নিচে নিশ্চিন্দাপুরে যেখানে মিঠা পানি শুরু, সেখান থেকে ওপরে আপনি যদি দুশো কিলোমিটারেরও বেশি ওপরে বলাগড় অবধি যান, সেখানে ক্যালেন্ডার করে আমরা দেখতে পাচ্ছি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ-প্রাক মনসুন-মনসুন কিংবা পোস্ট-মনসুন … সারা বছরই কিন্তু এই পুরো এলাকা জুড়ে ইলিশ মিলছে।”

তবে অধ্যাপক নাথ সেই সঙ্গে বলছিলেন, বিশেষত বর্ষার পর কৃষিক্ষেতের কীটনাশক-যুক্ত জল যখন এসে নদীগুলোতে মেশে, তখন এই মিঠা পানির ইলিশগুলোর বিরাট ক্ষতিও হয়ে যাচ্ছে।

মিঠা জলের নদীতে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য এই ইলিশদের বেশি দূষণের শিকার হতে হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো কিন্তু অন্য ইলিশের চেয়েও ভাল, বলছিলেন ড: মহাপাত্র।

তার কথায়, “মিঠা পানিতেই কিন্তু ইলিশের স্বাদ বাড়ে – কারণ নদীতে ঢোকার পরই তাদের শরীরে ফ্যাট বাড়ে, সেগুলো খেতেও অনেক ভাল হয়। গভীর সমুদ্রে ধরা ইলিশের স্বাদ কখনওই তেমন হয় না। ফলে এগুলোর স্বাদ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই!”

ইলিশ কখনও সাগরে না সাঁতরালে তাকে আদৌ সত্যিকারের ইলিশ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য মৎস্য বিজ্ঞানী আর খাদ্য-রসিকদের মধ্যে দু’রকম মত আছে।

কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বেশ কিছু ইলিশ আর কখনওই সাগরে ফেরার টান অনুভব করছে না

যেসব কারণে বাংলাদেশে এখন ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ

গত ২০শে মে থেকে ২৩শে জুলাই, টানা ৬৫ দিন ইলিশ আরোহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মৎস্য অধিদফতর।তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তারও অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় ইলিশ মাছ ধরার স্বাভাবিক কার্যক্রম।

এতো দীর্ঘ বিরতির পর ২৩শে জুলাই রাত থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর থেকে জেলেরা ট্রলার, বোট বোঝাই করে ইলিশ ধরতে থাকে।দীর্ঘসময় মাছ ধরা বন্ধ থাকায় সেইসঙ্গে এ বছরের বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার কারণে নদীতে পানি প্রবাহ বেড়েছে এবং ইলিশ আগের চাইতে বেশি ধরা পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার পর্যায়ক্রমে কিছু পদক্ষেপ হাতে নেয়ার কারণে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে মনে করেন ইলিশ গবেষক নিয়ামুল নাসের।সবার আগে তিনি জাটকা ও মা ইলিশের বিচরণক্ষেত্র সংরক্ষণের বিষয়টি তুলে আনেন।

ইলিশ মাছের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে গত কয়েক বছর ধরে দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে আসছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

এ আদেশ অমান্য করলে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।এ কারণে এখন আর আগের মতো বছরব্যাপী অবাধে ইলিশ আহরণের সুযোগ নেই।

ইলিশের উৎপাদন বাড়ার কারণ হিসেবে মি. নাসের “প্রিয়দেশ নিউজ”কে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নদীর পানির গুনাগণ ও প্রবাহ ইলিশের প্রজননের জন্য এখনও অনুকূলে আছে। এ কারণে ডিমওয়ালা মা ইলিশ সাগর থেকে স্রোতযুক্ত মিঠাপানির নদীতে এসে ডিম ছাড়ে।

তিনি বলেন, “ইলিশ মাছ জুলাই মাসের দিকে সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে শুরু করে। এ সময় তারা পদ্মার দিকেই আসে। কারণ পদ্মার পানির স্তর ও গভীরতা অন্য নদীর চাইতে তখন বেশি। এ কারণে এতো বেশি মাছ পাওয়া যায়।”

এছাড়া সামুদ্রিক নিম্নচাপ এবং সাইক্লোনের একটা প্রভাব থাকার কারণেও ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। তবে নদীর প্রবাহ ও গভীরতা দিন দিন কমে আসার কারণে এই ইলিশের আহরণ টেকসই থাকবে কিনা সেটা নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রথমত, বাংলাদেশের এই নদীগুলো প্রচুর পলি বয়ে আনায় নদীর তলদেশ প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে।এভাবে পলি জমতে জমতে যদি নদীর গভীরতা ও পানি প্রবাহ কমে যায় তাহলে ইলিশ আর নদীতে আসতে চাইবে না বলে আশঙ্কা ইলিশ গবেষকদের।

এই ইলিশ মূলত সমুদ্র থেকে ছোট ছোট শাখা নদীর মাধ্যমে বড় নদীগুলোয় প্রবেশ করে।সেই ছোট শাখার অনেকগুলো পলি জমে বন্ধ হতে থাকায় ভবিষ্যতে ইলিশের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।এছাড়া কীটনাশক ও শিল্প কারখানার কেমিকেল নদীতে ফেলার কারণে যে দূষণ হচ্ছে সেটাও মাছের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে বলে জানান মি. নাসের।

ইলিশের উৎপাদন টেকসই রাখতে নদীর পাশাপাশি সমুদ্রেও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।”সমুদ্রের কোন অংশে ইলিশ বিচরণ করে সেটা গবেষণার মাধ্যমে বের করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যে জাটকাগুলোকে আমরা নদী থেকে সমুদ্রে পাঠাচ্ছি, সেটা যেন সমুদ্রে টিকে থাকতে পারে এজন্য ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে নো ট্রলার জোন করতে হবে”।

ইলিশ উৎপাদনের বিষয়টি জলবায়ুর ওপরেও অনেকটা নির্ভর করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো কারও একার পক্ষে সম্ভব না। এক্ষেত্রে সমুদ্র ও নদীতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র রক্ষার ওপরেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

সু-স্বাদু ইলিশ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

ইলিশের ভালো-মন্দ নিয়ে ধন্দে থাকেন কম বেশি সবাই। মানে কোন ইলিশ ভালো, কোন ইলিশের স্বাদ বেশী, কোন ইলিশ নদীর আর কোনটাই বা সমুদ্রের ইলিশ।

সরকারের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলছেন, ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকে। শুধু ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। “দুইটি ইলিশই টর্পেডো আকারের। কিন্তু নদীর ইলিশ একটু বেঁটেখাটো হবে, আর সাগরের ইলিশ হবে সরু ও লম্বা।

সেই সঙ্গে নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল। নদীর ইলিশ চকচকে বেশি হবে, বেশি রুপালী হবে রং। সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল।” এছাড়া নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার ইলিশ মাছের আকার হবে পটলের মতো অর্থাৎ মাথা আর লেজ সরু আর পেটটা মোটা হতে হবে।

এক্ষেত্রে লেজের একটু উপর থেকেই মাছটা গোল হতে শুরু করবে।তবে, মিঃ রহমান বলছেন, নদী আর সাগরের ইলিশ মাছের আসল পার্থক্য বোঝা যাবে খাওয়ার সময়।

মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রহমান বলছেন, সাগর থেকে ইলিশ যখন ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে, মানে উজানে আসে তখন নদীর যে প্ল্যাংটন বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী খায় ইলিশ মাছ তার কারণে তার শরীর বেটে ও মোটা হয়।এই খাবারের কারণেই ইলিশের শরীরে এক ধরণের চর্বি জমে, যা তার আকৃতিকে সাগরের ইলিশের চেয়ে আলাদা করে।

যে কারণে ইলিশ বেশী স্বাদের হয়?

“সমুদ্র থেকে ইলিশ নদীতে ঢোকার পরে নদীর উজানে মানে স্রোতের বিপরীতে যখন চলে, সেসময় এদের শরীরে ফ্যাট বা চর্বি জমা হয়। এই ফ্যাট বা তেলের জন্যই ইলিশের স্বাদ হয়।”বর্ষাকালে পাওয়া ইলিশের স্বাদ বেশি হয়। মিঃ ওসমান বলছেন, বর্ষার মাঝামাঝি যখন, ইলশে গুড়ি বৃষ্টি হয়, সেই সময়ে নদীতে পাওয়া ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে বেশি।

এদিকে, মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ড. আনিসুর রহমান বলেন, লোনা পানি ও মিঠা পানিতে বসবাসের কারণেও ইলিশের স্বাদে কিছুটা পার্থক্য হয়। আর সেক্ষেত্রে নদীর ইলিশের স্বাদই বেশি হয়।এছাড়া ডিম ছাড়ার আগ পর্যন্ত ইলিশের স্বাদ বেশি থাকে। ডিমওয়ালা ইলিশে মাছের পেটি পাতলা হয়ে যায়, এবং চর্বি কমে যায়—এ কারণে স্বাদ কমে যায়।

যে কারনে পদ্মার ইলিশের এত সুনাম

পৃথিবীর মোট ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারসহ নানা-দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়।এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পদ্মার ইলিশ। পদ্মার ইলিশের এই ব্যাপক খ্যাতির কী কারণ?

মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ড. আনিসুর রহমান বলেছেন, পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায় যে ধরণের খাবার খায় ইলিশ, এবং পানির প্রবাহের যে মাত্রা তার ফলে এর শরীরে উৎপন্ন হওয়া চর্বিই এর স্বাদ অন্য যেকোন জায়গার ইলিশের চেয়ে ভিন্ন করেছে।ইলিশের জীবনচক্রের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইলিশ সমুদ্র থেকে এসে নদীতে ডিম ছাড়ার পর বাচ্চা ইলিশ আবার সমুদ্রে ফিরে যায়।এবং তার যখন আবার প্রজনন মৌসুম আসে, অর্থাৎ ডিম ছাড়ার সময় হয়, সে তখন যেখানে তার জন্ম সেখানে ফিরে যায়। ফলে বছরের পর বছর ধরে পদ্মার ইলিশের সুখ্যাতি বজায় রয়েছে।

ইলিশ চেনার উপায়?

বাজারে ইলিশ সংক্রান্ত যেসব আলাপ প্রচলিত, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডিমওয়ালা ইলিশ আর ডিমছাড়া ইলিশ কেমন করে চেনা যাবে?

ড. আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে ক্রেতা একটু অভিজ্ঞ না হলে মুশকিল।তিনি বলেন সাধারণত অগাস্ট মাসের পর থেকে শুরু হয় ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম, চলবে সেপ্টেম্বর অক্টোবর পর্যন্ত। তবে এখন তো বারোমাস বাজারে ইলিশ পাওয়া যায়।

“ডিমওয়ালা ইলিশের পেটমোটা হবে এবং এটা চ্যাপ্টা হয়ে থাকে। এছাড়া ডিমওয়ালা ইলিশের পেট টিপলেই মাছের পায়ুর ছিদ্র দিয়ে ডিম বেরিয়ে আসবে। আর ডিম ছাড়া মাছের পেট আলগা বা ঢিলা থাকবে।”

যে ইলিশ কেনা উচিত নয়

ইলিশের খ্যাতি এর স্বাদের জন্যই। ফলে ছোট ইলিশ বা জাটকা কখনোই কেনা উচিত নয়।কারণ ওগুলোর স্বাদ হয় না।এছাড়া ইলিশ যদি দীর্ঘদিন কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে এর স্বাদ কমে যায়।এটা চিনতে হলে খেয়াল রাখতে হবে এই মাছের ঔজ্জ্বল্য কম থাকবে।এছাড়া একটু নরম মাছ দেখলে বুঝবেন সেটা কয়েকদিন আগের আনা বাসি মাছ।

ইলিশের উপকার

ইলিশ মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী বলে জানান মৎসবিজ্ঞানীরা।ড. রহমান বলছিলেন “ইলিশ মাছে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়াম। এই মাছ খেলে হৃদযন্ত্র ভালো থাকে, মস্তিষ্কের গঠন ভালো হয়, রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাক, এবং বাত বা আর্থারাইটিস কম হয়। ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারও কম হয়।”

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

কেবল খাবার খাবার পাতে নয়, সাহিত্যে এমনকি কূটনীতিতেও ইলিশ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে অনেকবারই।মাত্র গত মাসেই অর্থাৎ জুলাই মাসের শুরুতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বিধানসভায় অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারত তিস্তার পানি না দেয়ায় পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।

এমনকি বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৭ সালে ইলিশ মাছ স্বীকৃতি পেয়েছে।ফলে বাঙ্গালীর ইলিশ প্রীতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে।যদিও বেশি কাঁটা ও গন্ধের কারণে বাকী পৃথিবীর কাছে ইলিশের সমাদর তেমন নয়।

কীভাবে ইলিশের ‘জীবন রহস্য’র উৎপাদন বাড়াবে

২০১৭ সালে ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মেধা-স্বত্ব কর্তৃপক্ষ।২০১৮ সালে এই মাছটির পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচনের কৃতিত্ব অর্জন করলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।

ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার গবেষক ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। ২০১৫ সাল থেকে এই জিনোম সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেন তারা।এই সফলতা ইলিশ মাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ইলিশ জিনোম সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যাসেম্বলি নামের এই গবেষণা দলটির সমন্বয়ক হিসেবে আছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ. সামছুল আলম।জেনম কি এবং এ সংক্রান্ত তথ্য কী কাজে লাগে। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,

“জিনোম হচ্ছে কোনও জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোমের মাধ্যমে।””ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকে। শুধুমাত্র ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। আর এই পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যাবে এরা কখন, কোথায় ডিম দেবে। ”

বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের মজুত কত,কোন ভৌগোলিক এলাকায় এর বিস্তৃতি কী পরিমাণে এসব বিষয়ে জানা যাবে বলে জানান ড. মোঃ. সামছুল আলম।বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে।এছাড়া পৃথিবীর মোট ইলিশের প্রায় ৬০ ভাগ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে।

এই বিপুল চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো। আর সেজন্য ইলিশের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজননসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা জরুরি বলে মনে করেন গবেষকরা।তাদের এই গবেষণা ইলিশের উৎপাদন বাড়িয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করবে বলে মনে করেন গবেষণা দলের আরেক সদস্য ড. মোঃ. বজলুর রহমান মোল্লা।

তিনি গবেষণার তিনটি গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন।”প্রথমত ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স জানার মাধ্যমে ইলিশের টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা যাবে। “”এছাড়া ইলিশের জন্য দেশের কোথায় কোথায় ও কতটি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা বা তুলে নেয়া প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা যাবে।”

“সেইসঙ্গে অন্য দেশের ইলিশ থেকে আমাদের ইলিশ বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্বতন্ত্র কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে”, বলে জানান ড. মোঃ. বজলুর রহমান মোল্লা। এই গবেষণা যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা হয় তাহলে বাজারে আগের চাইতে বেশি পরিমাণে এবং বেশি সময় ইলিশ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিষয়টাকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা এবং দুই সন্তানের মা জাহানারা বেগম। তিনি বলেন,

“বাচ্চারা মাছের মধ্যে ইলিশ মাছটাই খুব পছন্দ করে। কিন্তু ইলিশ সব মৌসুমে পাওয়া যায়না। পাওয়া গেলেও দাম এতো বেশি থাকে যে সব সময় চাইলেই কিনতে পারিনা। অপেক্ষা করতে হয় কবে ইলিশের সিজন আসবে। তবে ইলিশ যদি এখন বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়, দামটা যদি হাতের নাগালে থাকে। তাহলে আমাদের জন্য অনেক ভাল হয়।”

বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা থেকে পূর্ণবয়স্ক ইলিশ মাছ সংগ্রহ করে প্রায় দুই বছর ধরে গবেষণার পর এই সফলতা অর্জন করেন তারা।পরে গবেষণালব্ধ ফলাফল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। তবে একে আরও সমৃদ্ধ করতে গবেষণা চলছে বলে জানান পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বজলুর রহমান।

গবেষণা দলের অপর দুইজন হলেন, বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ গোলাম কাদের।আট বছর আগে পাটের দুটি জাতের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছিলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।