শ্রমিকদের ক্ষতিপূরন দিয়ে অবসর পাঠানোর সদ্ধান্তে শ্রমিক অসন্তোষ:সরকার কি বলছে?

শ্রমিক সংগঠনগুলির লাগাতার প্রতিবাদ চলছেই। তবে সরকারও অনড়।এমনই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সরকারের। করোনা হামলায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি। তার প্রভাব পড়ল দেশীয় পাট শিল্পে। দেশের ২৬টি পাটকলের হাজার হাজার শ্রমিককে স্বেচ্ছাবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল সরকার।

সরকার অব্যাহত লোকসানের কথা তুলে ধরে ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে প্রায় পঁচিশ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কর্মসূচির মাধ্যমে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। কিন্তু করোনাভাইরাস দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে যখন বেসরকারি খাতে অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন, তখন সরকার এমন পদক্ষেপ কেন নিয়েছে, পাটকল শ্রমিকরা সেই প্রশ্ন তুলেছেন।

সরকার বলেছে, অনেক আগের সিদ্ধান্ত এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে অবসরে পাঠানোর সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা এক হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রক্ষা শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলনে নেমেছেন।

এই আন্দোলনের প্রথমদিনে আজ সরকারি প্রতিটি পাটকলের গেটের সামনে শ্রমিকরা তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে দুই ঘন্টা অবস্থান করেছেন।পাটকল শ্রমিক নেতারা শ্রম প্রতিমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সোমবার তার সাথে বৈঠকেও যোগ দিয়েছিলেন। সেই বৈঠকে কোন ফল হয়নি।

শ্রমিক নেতারা বলেছেন, করোনাভাইরাস দুর্যোগের এই সময়ে সরকার কেন তাদেরকে অবসরে পাঠাচ্ছে, এই প্রশ্নে তারা সঠিক কোন জবাব পাননি।শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, পাটকলগুলো বছরের পর বছর ধরে লোকসানে থাকায় এখন এগুলো বন্ধ করা ছাড়া সরকারের বিকল্প নেই। তিনি মনে করেন, এখন শ্রমিকরা তাদের পাওনা ঠিকমত পাচ্ছেন কিনা- সেটা নিশ্চিত করা উচিত।

“রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লোকসান দিতে দিতে এমন জায়গায় এসে পৌঁছায়ছে যে, এখন এটা সামনে নাকি পিছনের দিকে যাবে, এটা বোঝার মতো শক্তি আমরা হারায় ফেলছি।”

তিনি আরও বলেছেন, “এখন আর আগে-পরের বিষয় নয়। এখন গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের যে কথা বলা হচ্ছে,তাতে একজন শ্রমিক ১২ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা পাবে। আর সর্বোচ্চ ৫৪ লাখ টাকাও পাবে। একসাথেই তা দেয়া হবে। সুতরাং এখন আর তখন বড় বিষয় নয়, শ্রমিকরা যাতে না ঠকে, সেটাই হচ্ছে বড় কথা।”

শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে খুলনার খালিসপুরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি পাটকল বন্ধ করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেগুলোও চালু করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লাভজনক করার জন্য সংস্কার কার্যক্রমও নেয়া হয়েছিল। তারা মনে করেন, সেই কার্যক্রমও গাফিলতি এবং অবহেলার ফাঁদে পড়েছিল।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রক্ষা শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক শাহানা শারমিন বলেছেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং আধুনিকায়ন না করার কারণে পাটকলগুলো লোকসানেই থাকছে। কিন্তু দায়ভার শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে তাদেরকেই বিদায় করা হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।

“২০১৬সালেও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর খরচ এবং লাভ সমান সমান ছিল। লোকসান ছিল না। ২০১৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যা করা হচ্ছে, তা হচ্ছে, পাট কেনা হচ্ছে না সময়মতো। তারপর যে পণ্য তৈরি হচ্ছে, তা সরকারের করপোরেশনের খামখেয়ালির কারণে বাজার পাচ্ছে না।

”পাটের মৌসুমেও একটা দাম ঠিক করে দেয়া হয়। ফলে ভাল পাট পাওয়া যায় না। খামখেয়ালি এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তিন বছর ধরে লোকসান হচ্ছে। এর কারণ কিন্তু খতিয়ে দেখা হয় না,” বলছেন শাহানা শারমিন। খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-এই চারটি বিভাগে ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে প্রায় পঁচিশ হাজার শ্রমিক রয়েছেন।

গত দুই বছর ধরে তাদের বেতন ভাতাও আদায় করতে হয় আন্দোলন করে। এখন তাদের অবসর নেয়ার প্রশ্ন এসেছে। তারা এই করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝে চাকরি থেকে বিদায় নেয়ার বিষয়টি মানতে পারছেন না।

তবে পাটকলের লোকসানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগ মানতে রাজি নন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। রাষ্ট্রায়ত্ব সব পাটকল বেসরকারি অংশীদারিত্বে ছেড়ে দেয়ার চিন্তা সরকারের নীতির বড় ধরণের পরবর্তন।

মন্ত্রী বলেছেন, তিনি বলেছেন, শত শত কোটি টাকার লোকসানের কারণে এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেয়া হয়েছে। এর সাথে কররোনাভাইরাস পরিস্থিতিকে মিলিয়ে দেখা ঠিক হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

“এত লোকসান। এরপরে ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাদের বেতনই ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়। আর অন্য সমস্যাতো আছেই।”

বিভিন্ন সময় বেতন ভাতার দাবিতে পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলনের সমালোচনা করে পাট মন্ত্রী বলেছেন, “প্রতি তিন মাস পর পরই এরা আন্দোলন করে রাস্তায় নেমে সরকারের কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে যায়। আমাদের ব্যাংকে দেনা আছে। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব বিল বাকি আছে।।”

তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০১৪ সালে প্রায় নয় হাজার শ্রমিক অবসরে গেছেন, তাদের পাওনা দেয়া হয়নি। সেই টাকা ভাঙিয়ে এখন কল চালানো হচ্ছে।”এখন ২৫ হাজার শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক-এর আওতায় সব পাওনা দিতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। এছাড়া ব্যাংকের বকেয়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের জন্য প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা দেনা রয়েছে।”

মন্ত্রী মি: গাজী আরও বলেছেন, “এই টাকাগুলো এখন শোধ করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি এটা মুক্ত করতে পারবো তত তাড়াতাড়ি বেসরকারি অংশীদারিত্বে দিয়ে নতুন করে শুরুর চেষ্টা করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই কাজ দ্রুত ছয় মাসের মধ্যে করতে পারবো কিনা-আমি বলেছি পারবো। আমরা এক বছর আগে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন বাস্তবায়ন করছি। কিন্তু তা করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে।”

শ্রমিক নেতারা বলেছেন, করোনাভাইরাস দুর্যোগে সরকারের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সরকার তড়িঘড়ি করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা-এই প্রশ্ন তাদের মধ্যে রয়েছে। পাটকল শ্রমিকরা মঙ্গল এবং বুধবার প্রতিটি কারখানার গেটে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছেন। এরপর তারা আমরণ অনশনের কর্মসূচি রেখেছেন।

লুটপাটের বলি পাটশিল্প
তার মানে বেসরকারি অংশীদারিত্বে পরিচালিত হলে লোকসান হবে না। একথা স্পষ্ট যে, পাট সেক্টরের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং পাট মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির অবহেলার কারণেই অমিয় সম্ভাবনার পাটশিল্প আজ পথ হারিয়েছে। সরকারের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, লুটপাট আজ পাটশিল্পকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। অথচ কয়েক দশক ধরে এই শিল্পই বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ ছিল। ছাটাই কোন সমাধান নয়। শ্রমিকদেরকে ছাটাই না করে কীভাবে পাটকলকে লাভজনক করা যায় সে উপায় বের করা দরকার ছিলো। প্রতিটি সরকারের লুটপাটের বলি এই পাটশিল্প। শ্রমিকরা বলছেন, ‘লোকসান হয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নীতি নির্ধারণের কারণে।’ এই দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা কখনোই নেয়া হয়েছিলো কী? ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষকে সুবিধা দিতে সাধারণ নাগরিকরা এই লোকসানের বোঝা কতোদিন কেনো বহন করবে, আর শ্রমিকদেরও কেনো ছাঁটাই করা হবে? পাটচাষি, পাটপণ্য উৎপাদক, রপ্তানিকারকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনা এবং উপযুক্ত বাজারমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি পাটকলে অনিয়ম, অদক্ষতা, উৎপাদনহীনতা ও দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হলে পাটশিল্পে লাভ করা সম্ভব হতো।

পাটকলগুলোর লোকসানের কারণ
পাটকলগুলোর আয় কমে যাওয়া এবং বছরের পর বছর লোকসানের কারণ হিসেবে বিজেএমসির শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শ্রমিকনেতারা গণমাধ্যমকে বলেন, লোকসানের বড় কারণ কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। এ ছাড়া সরকারি পাটকলের উৎপাদনশীলতা কম অথচ উৎপাদন খরচ বেশি। ভরা মৌসুমে পাট কেনা হলে ও উৎপাদিত পণ্য ঠিকমতো বিক্রির ব্যবস্থা করলে মিলগুলোয় কোনো ক্রমেই লোকসান হওয়ার কথা নয়ং। পাটকলগুলোয় পাট ক্রয় থেকে কারখানা চালানোর নানা স্তরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়ে থাকে। কম পাট কিনে বেশি দেখানো, ময়েশ্চার বা ভেজা পাট কিনে শুকনা পাটের দাম দেওয়া  ইত্যাদি নানা দুর্নীতির চলে।

লোকসানের দায় শ্রমিকদের ওপর চাপানো কোনো 
মৌসুমের শুরুতে যখন পাটের দাম কম থাকে, বিজেএমসি তখন পাট না কিনে পরে বেশি দামে কেনে। এ বিষয়ে সংস্থাটির সময়মতো বরাদ্দ না পাওয়ার অজুহাতও ধোপে টেকে না। সময়মতো বরাদ্দ আনার দায়িত্ব কি তাদের নয়? সরকারি খাতের প্রায় প্রতিটি পাটকলে বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত পণ্য পড়ে আছে। পাটপণ্য বিক্রির দায়িত্ব নিশ্চয়ই শ্রমিকদের নয়। আর স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে এ লোকসানের সঙ্গে শ্রমিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। কারখানাগুলোর লোকসানের দায় কোনোভাবেই শ্রমিকদের ওপর চাপানোর সুযোগ নেই। অন্যদিকে, বেসরকারি পাটকলগুলো লাভজনক হলেও কেন রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো ফি বছর বিপুল অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে হবে। পাশাপাশি দলাদলি, স্বজনপ্রীতি, কায়েমি স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে।

আধুনিকায়ন ও লাভজনক করা সম্ভব
বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ গোল্ডেন হ্যান্ডশেক হিসেবে না দিয়ে পাটকলের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের জন্য ব্যয় করলে পাটকলগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব। পাটকলগুলো পিপিপি মডেলে চালানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়ার মতোই। যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন ও সময়মতো কাঁচা পাট কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিলেই সরকারি পাটকলগুলো লাভের মুখ দেখবে। বিজেএমসির দুর্বল বিপণন ব্যবস্থাপনা জোরদার ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদেরও অপসারণ করতে হবে। বর্তমানে পিপিপির মাধ্যমে পরিচালনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে কী-না কে বলতে পারবে? পাটকলগুলো পরিচালনার যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বিশ্বজুড়ে পাটের কদর বৃদ্ধি


পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যের অতি ব্যবহারের দরুন বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে পাটসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তুর কদর বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদে দ্বিতীয় কমিটিতে ‘প্রাকৃতিক তন্তুর উদ্ভিজ্জ ও টেকসই উন্নয়ন’ শিরোনামে পাটসহ প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে পাটের কদর ও ব্যবহারিক মূল্য বৃদ্ধির একটি সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে পাটের তৈরি নানাবিধ ও বহুমুখী পণ্যের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কিন্তু বহুমুখী পাটপণ্যের উপযোগী কাঁচামাল তৈরির উৎপাদনের ক্ষমতা বিজেএমসির পাটকলসমূহের মোটেই নেই। এ ছাড়া প্রায় অর্ধশত বছর পূর্বের যন্ত্রপাতি দিয়ে স্থাপিত এসব মিলের কার্যক্ষমতা সময়ের ব্যবধানে হ্রাস পেয়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। বিজেএমসির পুরনো ব্যবস্থাপনা কাঠামো আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার উপযোগী তৈরি না করার কারণেই পাটশিল্পের মরণদশার কারণ।

পাটের কোনো কিছু ফেলনা নয়
পাট এমন একটি পণ্য, যার কোনো কিছুই ফেলনা নয়। পাট পরিবেশবান্ধব, বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য আঁশ। তারপরও পাটে এতো লোকসান কোনো? আমরা লোকসানের কথা শুনতে চাই না। বরং পাটশিল্প কীভাবে লাভজনক হবে সেদিকেই মনোযোগ দিতে হবে। শিল্পবিপ্লবের সময় হতেই অন্যান্য কৃত্রিম আঁশের স্থান দখল করে পাটের যাত্রা শুরু। পাটের আঁশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, অন্য অনেক আঁশের সাথে মিশ্রণ করে পাটকে ব্যবহার করা যায়। বিশ্বব্যাপী যখন পরিবেশবান্ধব পাটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের লোকসানের বোঝায় অচৈতন্য অবস্থা। দুর্নীতি রোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং মাথাভারী প্রশাসন কাটছাঁটের মাধ্যমে পাটকলগুলোর লোকসান কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রতিবেশী দেশে এবং দেশের ভেতরে বেসরকারি পাটকলগুলো লাভজনক হলেও প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত লোকসান গুনছে। এজন্য পাটশিল্প হতে সর্বোচ্চ সুফল পেতে আমাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনায় হালনাগাদ করা ছাড়াও পাটজাত পণ্যের যুগোপযোগি ব্র্যান্ডিং করতে হবে। বিশ্ববাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তাহলে পাটচাষি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন।

ইতিহাসে পাটশিল্প

১৮৫০ খ্রীস্টাব্দের মধ্য এ অঞ্চলের পাট শিল্প সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। পাট শিল্পে বাংলাদেশঃ মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হওয়ায় উষ্ণ ও আদ্র জলবায়ুর এবং মাটির কারনে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পাট এ অঞ্চলেই জন্মে। সেই সুবাদেই ১৯৫১ খ্রীস্টাব্দে বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জ শহরের শীতলক্ষ্যার তীরে ২৯৭ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল্স। এটি ছিল তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ২য় পাট কল (প্রথমটি হল বাওয়া পাট কল)। এর আগে সমস্ত পাট রপ্তানী হতো বিদেশের বাজারে। আদমজীকে এক সময় বলা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি (স্কটল্যান্ডের ডান্ডির নামানুসারে)।

পরবর্তীতে মূলত ষাট ও সত্তর এর দশকে দেশে অসংখ্য পাটকল স্থাপিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানের বাংলাদেশ) এর উন্নতমানের পাট ব্যবহার করে আদমজী পাটকলে উৎপাদিত হতো চট, কার্পেটসহ বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দ্রব্য। যা দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি হতো চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এ সময় আদমজী জুট মিল হয় পৃথিবীর অন্যতম জুট মিল এবং এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ কারখানা ছিল। ঐ সময় এ মিলের উৎপাদন হইতে বছরে ৬০ কোটি টাকা আয় হত। ১৯৭০ এর দশকে প্লাস্টিক ও পলিথিন পাটতন্তুর বিকল্প হিসেবে আতœপ্রকাশ করলে আদমজী পাটকলের স্বর্ণযুগের অবসান হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে ১৯৮০ এর দশকের কয়েকটি বছর ব্যতীত অন্য সব বছর এটি বিপুল পরিমাণে লোকসান দেয়। শ্রমিক ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বাধা সত্ত্বেও ২০০২ খ্রীস্টাব্দের ২২শে জুন এই কলটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতায় একের পর এক মিল বন্ধ হতে থাকে। অনেক বিশেষজ্ঞদেরে মতে শুধুমাত্র আদমজী বন্ধ করার মাশুল এ দেশকে বহুবছর দিয়ে যেতে হবে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্টের পরিবেশ সংরক্ষন বিষয়ক দপ্তর (ইপিএ) খুঁজে পেয়েছে বিশ্বব্যাপী প্রতি মিনিটে প্রায় ১ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ পুনঃব্যবহারযোগ্য করা হচ্ছে (বিবিসি,সিএনএন)। সঠিক পরিবেশ পেলে একটি প্লাস্টিক ব্যাগ প্রাকৃতিক পরিবেশে মিশে যেতে প্রায় ১০০০ বছর লাগে।এটি মাটির মধ্যে অবস্থান করে অক্সিজেন ও পানির প্রবাহকে ব্যাহত করে। পোড়ানো হলে এর বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ু দূষন করে , সমুদ্রে পড়লে আরও অনেক বেশী ক্ষতি সাধন করে। বিশ্বজুড়ে এর ভয়াবহতা বুঝতে পেরেই ২০০৩ থেকে এই পর্যন্ত আফ্রিকা, এশিয়া প্যাসিফিক, দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র সহ আরো অনেক দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে থাকে। তখন বিকল্প হিসেবে পুনঃব্যবহারযোগ্য কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের কথা ভাবা হয়।

কিন্তু যখন স্বাস্থ্য বিনষ্ট, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষনের কথা মাথায় আসে তখন সবার প্রথম পছন্দ হিসেবে চলে আসে পরিবেশ বান্ধব “পাট”। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অগ্রগতিঃ দুঃখজনকভাবে এ শিল্প বহুভাবে অবহেলিত হলেও, পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক বাজার ও পরিবেশ বান্ধবের কারনে সরকার এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে কিছু যুগোপযুগী পদক্ষেপ গ্রহন করেন। যা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেমনঃ- পাটখাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে “পাটনীতি” প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে “পণ্যের মোড়কীকরণে পাট পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০” পাশ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাট উৎপাদক ও রপ্তানীকারক সংস্থা “বিজেএমসি”কে (বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন) আধুনিক করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে। পাটপণ্যের পরিচিতির জন্য দেশীয় ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় পাটজাত পণ্যের প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলো পুনরায় চালুর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ও নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক “গোল্ডেন ফাইবার” এর নাম পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে দেশের পাট খাতের জন্য ১ বিলিয়ন টাকা পুনঃঅর্থনৈতিক সংস্থানের তহবিল তৈরির ঘোষণা করে। ১৯/০৮/২০১৩ ইং তারিখে বাংলাদেশ পাট গবেষনা ইনষ্টিটিউট এর বিজ্ঞানী ড. মকসুদুল আলমের নেতৃত্বে দেশি পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। অবশ্য এর আগে তারা এর পাটের আরেকটি জাত তোষা পাট ও পাটের জন্য ক্ষতিকারক একধরনের ছত্রাক ম্যাক্রোফোমিনা ফ্যাসিওলিনার জীবন রহস্য আবিষ্কার করেছিল।

যার সুফল অচিরেই এ শিল্পের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। বর্তমানে পাট শিল্প আবার তাঁর হারানো গৌরব ফিরে পেতে গুরু করেছে। সরকারী পাটকল গুলোকে আধুনিকায়ানের লক্ষ্যে নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে যুগোপযুগী প্রশিক্ষন ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অব্যাহত আছে। বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহন করার ফলে ১৯৮২-৮৩ সালের পর প্রথমবারেরমত “বিজেএমসি” ২০১০-১১ অর্থ বছরে ১৯.৫২ কোটি টাকা লাভ করে (সূত্রঃ বিজেএমসি বুলেটিন-এপ্রিল,২০১৩)। বর্তমানে দেশে সরকারী, বেসরকারী মিলে ১০০ এর বেশী পাটকল চালু আছে। দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট খাতের সঙ্গে জড়িত। পাটকলগুলোর উৎপাদিত পণ্যসমূহ হেসিয়ান, সেকিং, সিবিসি, জিওজুট/সয়েল, সেভার কম্বল, শপিং ব্যাগ,পাট ও প্লাস্টিকের সমন্বয়ে আসবাবপত্র ইত্যাদি। বর্তমানে বিশ্বের ৮৪ টি দেশে বিজেএমসির পাট ও পাটজাত পণ্য গৌরবের সাথে রপ্তাণী হচ্ছে এবং ১০০ এর বেশী দেশে রপ্তানীর সুসম্পর্ক বজায় আছে। বিশ্বে পাট পণ্য ব্যবহারের ৭৫ ভাগই প্যাকেজিং আইটেম। তাই পাটের বহুমুখী ব্যবহার ধরে রাখতে নতুন ও ভিন্নধর্মী পণ্য আবিষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।নতুন পণ্য তালিকায় আছে জুট প্লাস্টিক,দেয়াল আবরণী,বৃহদাকার ব্যাগ,চা-ব্যাগ,জিও-জুট,কম্বল,জুতো-স্যান্ডেল,স্কুল ব্যাগ, ব্রীফকেস, হ্যাট-টুপি ইত্যাদি।