লকডাউন ঘোষণা করে এবং বিধিনিষেধ আরোপ করেও বেঁধে রাখা গেল না মারণ ভাইরাসকে। গত ডিসেম্বরের গোড়ায় চিনে প্রথম থাবা বসায় যে নোভেল করোনাভাইরাস তারই সংক্রমণের শিকার এ বার ১ কোটি ছাড়াল। রবিবার পর্যন্ত গোটা বিশ্বে ১ কোটিরও বেশি মানুষ কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও প্রায় ৫ লক্ষ ছুঁইছুঁই। করোনার প্রকোপে এখনও পর্যন্ত গোটা বিশ্বে ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার ১২৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
মানব শরীরে কবে প্রথম করোনা থাবা বসায়, তা যদিও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। তবে গত বছরের ডিসেম্বরের গোড়াতে চিনের উহানেই প্রথম এই ভাইরাস থেকে সংক্রমণ ছড়ায়। তার মাস দেড়েক পর চিনা মেনল্যান্ড থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইল্যান্ডে ছড়ায় সংক্রমণ। উহানফেরত এক ব্যক্তির মাধ্যমে ২১ জানুয়ারি সংক্রমণ পৌঁছয় আমেরিকায়।
তার পর থেকে যত দিন গিয়েছে তর তর করে বেড়েছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এ বছর ৩ এপ্রিলের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা এসে ঠেকে ১০ লক্ষ ৪০ হাজার ৫৬৭-য়। সংখ্যাটা ৫০ লক্ষে পৌঁছয় ৪৮ দিনে। ২১ মে বিশ্বে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১ লক্ষ ২ হাজার ২৩-এ। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি হতে সময় লাগল মাত্র ৩৮ দিন। এ দিন ভারতীয় সময় দুপুর সাডে় তিনটে পর্যন্ত বিশ্বে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এসে ঠেকে ১ কোটি ১ হাজার ৫২৭-এ।
সংক্রমণ ছড়ানোর পাশাপাশি গোটা বিশ্বে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যাও। তবে শুরুর দিকে প্রতি দিনের মৃত্যু সংখ্যা কয়েকশো করে বাড়লেও, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তা কয়েক হাজার করে বাড়তে শুরু করে। গত ১০ এপ্রিল মৃত্যু সংখ্যা এসে ঠেকে ১ লক্ষ ৯৬৭-তে। রবিবার সেই সংখ্যাটা ৫ লক্ষে এসে পৌঁছতে সময় লাগল ৭৯ দিন।
আক্রান্তের নিরিখে এই মুহূর্তে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা। সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ লক্ষ ১০ হাজার ৩২৩। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্রাজিল। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ লক্ষ ১৩ হাজার ৬৬৭। ৬ লক্ষ ৩৩ হাজার ৫৪২ জন আক্রান্ত নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া। তালিকায় চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে থাকা ভারত ও ব্রিটেনে আক্রান্তের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫ লক্ষ ২৮ হাজার ৮৫৯ এবং ৩ লক্ষ ১১ হাজার ৭২৭-এ।
কোভিড-১৯-এর প্রকোপে মৃত্যু সংখ্যার নিরিখেও এই মুহূর্তে শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা। রবিবার পর্যন্ত সেখানে ১ লক্ষ ২৫ হাজার ৫৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্রাজিল। সেখানে এখনও পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা ব্রিটেনে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩ হাজার ৫৯৮ জন। তালিকায় চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে থাকা ইটালি ও ফ্রান্সের মৃত্যু সংখ্যা যথাক্রমে ৩৪ হাজার ৭১৬ এবং ২৯ হাজার ৭৮১-তে এসে পৌঁছেছে।
বছরের শুরু থেকে প্রতি দিন নতুন সংক্রমণ যে ভাবে বেড়েছে, গত কয়েক মাসে তাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারির শুরুতে যেখানে প্রত্যেক দিন ২ থেকে ৪ হাজার নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ছিল, মার্চের মাঝামাঝি তা ১০ থেকে ২০ হাজারের মধ্যে পৌঁছে যায়। এপ্রিলের শুরুতে আবার তা সর্বোচ্চ ৯২ হাজার পর্যন্ত ওঠে। বর্তমানে তা ১ লক্ষ ৫০ থেকে ১ লক্ষ ৬০ হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
লেখচিত্র-২-এ দৈনিক নতুন সংক্রমণের যে গ্রাফ দেওয়া হয়েছে, তাতে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় বা মুভিং অ্যাভারেজ ব্যবহার করা হয়েছে। চলন্ত গড় কী, তা লেখার শেষে নীচে দেওয়া হয়েছে—
একই ভাবে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রত্যেক দিন মৃত্যু সংখ্যা যেখানে ৪৫ থেকে ১০০ করে বাড়ছিল, মাস শেষ হতে হতে তা প্রায় ৩ হাজার করে বাড়তে শুরু করে। এপ্রিলের শেষ দিকে তা ১০ হাজার ৯০০ পর্যন্ত ওঠে। এই মুহূর্তে প্রতি দিন মৃত্যুর সংখ্যা ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজারের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে।
তবে যে চিন থেকে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে, গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি আয়ত্তে এনে ফেলেছে তারা। আগেভাগে সতর্কতা পাওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ পশ্চিমী দেশগুলিতে এখনও করোনার সঙ্গে যুঝে গেলেও, মাহামারি পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে চিন। আক্রান্তের নিরিখে গোটা বিশ্বে ২১তম স্থানে রয়েছে তারা। রবিবার পর্যন্ত সেখানে ৮৪ হাজার ৭৪৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রভাবে সেখানে এখনও পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৪১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বর্তমানে সেখানে সক্রিয় সংক্রামিতের সংখ্যা ৫১১। করোনার প্রকোপ থেকে চিনে এখনও পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠেছে ৭৯ হাজার ৫৯১ জন।
অন্য দিকে, দীর্ঘ সাত মাস ধরে নোভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেলেও, এখনও পর্যন্ত এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিয়ে এর প্রতিষেধক তৈরির কাজ চলছে। তবে আগামী বছরের শেষ দিকের তা হাতে পাওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন।
২০ জুনের-র তথ্য দেখা যেতে পারে। সে দিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬৫২। তার আগের দু’দিন ছিল ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৪৪৬ এবং ১ লক্ষ ৮১ হাজার ৫৬৩। পরের দু’দিনের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৩৫৬ এবং ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৯৮০। এই পাঁচ দিনের গড় হল ১ লক্ষ ৪৯ হাজার ৭৯৯। এটাই ২০ জুনের চলন্ত গড়। ঠিক একই ভাবে ২১ জুনের চলন্ত গড় হল ১৯ থেকে ২৩ জুনের আক্রান্তের সংখ্যার গড়। পরিসংখ্যানবিদ্যায় দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ সহজ ভাবে বোঝার জন্য এবং স্বল্পমেয়াদি বিচ্যুতি এড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়)
বাংলাদেশ
দেশে মোট ১৮০৯৯টি পরীক্ষা করে গত ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩৮০৯ জন।আর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৭ জন।এসব তথ্য জানা গেছে বলে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান।নতুন করে যতগুলো নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ২১.০৫ ভাগ মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
আর গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে মারা গেছে ৪৩ জন।এনিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মোট মারা গেলেন ১,৭৩৮ জন।গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৩ জনের বয়স পঞ্চাশের ওপর। বাংলাদেশে মোট শনাক্তের তুলনায় মৃতের হার ১.২৬%।
বয়স ভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান:২১ থেকে ৩০- ২ , ৩১ থেকে ৪০- ১ , ৪১ থেকে ৫০- ৭ , ৫১ থেকে ৬০- ১৩ , ৬১ থেকে ৭০- ১২ , ৭১ থেকে ৮০- ৭ , ৮১ এর বেশি ১ জন।
ঢাকায় ২১, চট্টগ্রাম ৩, খুলনায় ৩, রাজশাহীতে ২, সিলেটে ৩, রংপুরে ১, বরিশাল ২, ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন।হাসপাতালে মারা গেছেন ৩০ জন, বাড়িতে মারা গেছেন ১২ জন এবং মৃত অবস্থায় হাসপাতালে এসেছেন ১ জন।
আর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫৫ হাজার ৭২৭ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন। নতুন করে সুস্থ হয়েছেন ১৮০৯ জন । বাংলাদেশে শনাক্ত তুলনায় সুস্থতার হার ৪০.৪৪%।
মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা
এদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার খবর অস্বীকার করেছেন।তিনি বলেছেন, আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি এখনও দ্বিতীয়বার টেস্ট করান নি।
মাশরাফী তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি কোভিড-১৯ নেগেটিভ। এটি মোটেও সত্য নয়।”“এখনও পুনরায় টেস্ট করাইনি। ১৪ দিন হওয়ার পর পর টেস্ট করানো ইচ্ছে আছে।”মাশরাফী আরো লিখেছেন, বর্তমানে তিনি ভালো আছেন এবং বাসায় থেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার বড় কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। “সবাই সাবধানে থাকবেন, ভালো থাকবেন। আমরা সবাই মিলেই লড়াই চালিয়ে যাব।”
যুক্তরাষ্ট্র
টেক্সাসে পুনরায় দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ২৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।গত চব্বিশ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক লোক আক্রান্ত হয়েছেন ফ্লোরিডা ও টেক্সাসে।দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ব্যবসা বাণিজ্য পুনরায় খুলে দেওয়ার পর সেখানে সংক্রমণ বেড়ে গেছে।ফ্লোরিডায় শনিবার আক্রান্ত হয়েছে ৯,৫০০ জন, শুক্রবারের তুলনায় ৫০০ জন বেশি।এর পরপরই কর্তৃপক্ষ সেখানে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে।সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আরেকটি রাজ্য টেক্সাসেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কায় প্রচুর টেস্ট করা হচ্ছে।I
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে শ্রীলঙ্কায় গত মার্চ মাসে জারি করা লকডাউন সম্পূর্ণ তুলে নেওয়া হয়েছে।দেশটিতে দিনের বেলায় যে কারফিউ জারি করা হয়েছিল সেটা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। মধ্যরাতের আগে চার ঘণ্টার কঠোর বিধি-নিষেধও তুলে নেওয়া হয়েছে।স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে লোকজনকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। কঠোর লকডাউন এবং প্রচুর পরীক্ষার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার কম।
অস্ট্রেলিয়া
ভিক্টোরিয়ায় একটি নতুন সংক্রমণ শুরু হয়েছে। যা সিগারেটের লাইটার বিনিময় থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। একটি হোটেলের স্টাফরা এই সিগারেটের লাইটার নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেন। রাজ্যের প্রধান ড্যানিয়েল অ্যান্ড্রুজ বলেন সংক্রমণ হয়েছে একটি হোটেল থেকে। যেখানে সামাজিক দূরত্ব ছিল ঠিক কিন্তু একটি লাইটার তারা সবাই ব্যবহার করেন। রবিবারই ভিক্টোরিয়ায় নতুন করে ৪৯ জন রোগী পাওয়া গেছে, যা গত ২ মাসে সর্বোচ্চ।