টানা ১৩ ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এই প্রথম এমনটাই বলছেন স্থানীয়রা। ঘূর্ণিঝড় রিমাল পিছনে ফেলেছে ২০০৭ সালের সিডর কিংবা ৭০এর সেই ভয়াবহ বন্যাকে। যদিও গত রবিবার (২৬মে) আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছিল দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল, বরগুনা, ভোলা ও পটুয়াখালীতে ১০-১২ ফুট উচ্চ জলোচ্ছ্বাস সহ ১০ নাম্বার মহাবিপদ সংকেত। পরেরদিন সোমবার (২৭মে) আবহাওয়া অফিস থেকে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বলা হলে স্বাভাবিক ভাবে বাসস্থানে ফেরেন মানু। এরপরই হঠাৎ দমকা হাওয়ার সাথে বাড়তে থাকে জোয়ারের পানি। তখন এদিক সেদিক ছোটছুটি করেও স্থানীয়রা শেষ রক্ষা করতে পারেননি কাঁচা পাকা কারও ঘর।
বলা হচ্ছে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের কথা। গত রবিবার সকাল থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস থাকলেও এর মধ্যে ১৩ ঘন্টা ঘূর্ণিঝড় রিমাল’র তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উপজেলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নে।
জানা গেছে, উপজেলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চারপাশে তেতুলিয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত দ্বীপটিতে প্রায় ২২হাজার মানুষের বসবাস। তবে বিশাল এই জনগোষ্ঠী থাকলেও নেই পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র। নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি ও সুচিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা। ফলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আসলেই যেন মৃত্যু’কে আলিঙ্গন করতে হয়ে তাদের।
এদিকে মাত্রাতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসের কারনে প্লাবিত হয়েছে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম। অনেকের নেই মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয় স্থালটুকু। ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপার্জন বিমুখ করেছেন অনেক জেলে পরিবারকে। সরকারি সহযোগিতা কিংবা ত্রাণ না পেয়ে না খেয়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে চন্দ্রদ্বীপের হাজারও মানুষ।
ইউনিয়নের দক্ষিণ চরওয়াডেল এর বাসিন্দা রহিম সিকদার, ছিদ্দিক গাজী, দুলাল ও হাসিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমাদের ঘরের মাটি নাই, নদীর স্রোতের তীব্রতা এত বেশি যে বসত ঘরের মাটি নিয়ে গেছে। সারা রাত বসেই কাটাতে হয়। এই ভিটে ও ঘরটি ছাড়া দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই আমার। ছেলে মেয়ে নিয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।
চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ ছালাম হাওলাদার বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাস এতো পরিমাণ হয়েছে যা কল্পনা করতে পারিনি। ২০০৭ সালের সিডরের বন্যা দেখেছি ভেবেছিলাম তার থেকে বেশি হবে না। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমাল সিডর’কে হার মানিয়েছে।
চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের বন্যা কবলিত ভিটে হারা তিন সন্তানের জননী ফারজানা বলেন, ঘরের মাটি নেই রান্নার চুলা টয়লেট পুকুরের মাছ কিছুই নেই আমার। শেষ আশ্রয়স্থলটুকুও নিয়ে গেছে পানিতে পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে মরণ ছাড়া কিছু করার নেই আমার। খেয়ে না খেয়ে পঙ্গু স্বামী সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছি না মরে গেছি এখন পর্যন্ত দেখতে আসেনি কেউ। গত ৭ এপ্রিল ঘূর্ণি বাতাসে আমার ঘরটি ভেঙ্গেছিল। মেম্বার চেয়ারম্যান সহয়তার কথা বলে অনেকদিন পাড় করলেও কোনো সহায়তা দেয়নি। সরকারি সহয়তা চেয়ে ওই নারী বলেন, আমার ঘরটি পূর্ণ নির্মাণ ও আর্থিক সহায়তার দাবী জানাই না হলে ছপলে মেয়ে নিয়ে পথে বসতে হবে আমাদের।
গোল বানু বেগম বলেন, চাল চুলো কিছু নেই ঘরের মাটি নেই ছেলে মেয়ে নিয়ে মানুষের বাড়িতে ছিলাম হাস মুরগী সব নিয়ে গেছে বন্যায় এখন চৌকিতে বসে দিন রাত পার করছি।
খলিল খান বলেন, ৭ সদস্যের আশ্রয়স্থল ঘরটি এখন ভূতের বাড়ি হয়ে গেছে। ভিটেতে মাটি নেই। রাত হলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে কোনোরকম থাকি।
এদিকে রাস্তা ঘাট, ঘরবাড়ি ও স্কুল-মাদ্রাসা পানিতে তলিয়ে অতি দুরাবস্থায় কাটছে দক্ষিণ চর ওয়াডেলের মানুষের। ইউনিয়নের চর কচুয়া, চর ব্যারেট, চর রায়সাহেব ও চর মিয়াজান গ্রামের বাসিন্দারাও জানালেন তাদের দুরাবস্থার কথা। জামাল বেপারী, শাহাদাত হোসেন, সামচুল চৌকিদার সহ দুঃখ দূর্দশার কথা জানালেন অনেক ভুক্তভোগী পরিবার। তারা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে পানি বন্ধি হয়ে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি এখন সরকার আমাদের সহয়তা না দিলে আমরা আর ঘুরে দাড়াতে পারব না।
জেলে কামাল বেপারী বলেন, বন্যায় নৌকা জাল ঘরের মাটি নিয়ে গেছে এখন কী করব জানি না। নদীতে জাল না ফেললে জীবন চলে না আমাদের।
চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. এনামূল হক আলকাস মোল্লা গণমাধ্যমকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালে উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমার ইউনিয়নের বাসিন্দারা। বাড়ি-ঘড়, পুকুর, মাছের ঘেড় সব পানিতে তলিয়ে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে শুকনো খাবার দিয়ে সহযোগিতা করতেছি পাশাপাশি সরকারি ভাবেও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, চন্দ্রদ্বীপে ক্ষয়ে ক্ষতির সংখ্যা অনেক বেশি। অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসের কারনে ইউনিয়নের হাজারো মানুষ পানি বন্দি ছিলো। নিজের থাকার যায়গা টুকু হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রবল জোয়ারের তীব্র স্রোত ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে মূল কাছা পাকা রাস্তা ভেঙ্গে গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বশির গাজী গণমাধ্যম’কে জানান, চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নে সরকারি ভাবে ১৫কেজি করে ২’শ প্যাকেট শুকনো খাবার, ২৫০ প্যাকেট মুড়ি ও ২৫০ প্যাকেট চিড়া দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সরকারি সহযোগিতা পাওয়া মাত্র তাদেরকে পূনরায় সহযোগিতা করা হবে।