ওয়েব সিরিজ টেলিভিশনের মতো কোনো মাধ্যম না।ওয়েব সিরিজ দেখার জন্য আপনাকে কয়েক ধাপ পেরিয়ে সেটি কিনতে হবে।এটি একটি সেন্সর প্রক্রিয়া। অর্থাৎ আপনি কোনটি দেখবেন সেটি আপনিই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। ধরুন কেউ যদি মনে করে যে আমি হরর মুভি দেখবোনা তাহলে তিনি সেই কনটেন্ট দেখবেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি তো দাবি করতে পারেননা যে হরর মুভি সরিয়ে দিন"।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে সাবস্ক্রিপশন বেইজড একটি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম যেটা আপনাকে প্রথমে ডাউনলোড করতে হবে, তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করে সাবস্ক্রাইব করতে হবে এবং এরপর আপনি স্বেচ্ছায় ঠিক করতে পারবেন আপনি ঠিক কোন কন্টেন্ট দেখতে চান। এটা টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যম না যে সবাই মিলে একসঙ্গে দেখতে গিয়ে বিব্রত হতে হবে। আপনি সাবালক এবং উপার্জনক্ষম হলে তবেই স্বেচ্ছায় এই প্ল্যাটফর্ম কিনে দেখতে পারবেন যেটা কোনো নাবালক বা উপার্জন অক্ষম কারো পক্ষে সম্ভব না। একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার কন্টেন্ট থাকে ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী। একজন নির্মাতা তার সৃষ্টিশীল তাড়না এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে তার মতো করে একটা গল্প বলেন। তার গল্প এবং বক্তব্যকে দর্শকের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্যে তিনি গল্প বলার বা চিত্রকল্প তৈরি করার সব ধরনের টুল ব্যবহার করেন। এটা পুরোপুরি নির্মাতার স্বাধীনতা। তিনি সফল হলেন কি ব্যর্থ সেটা সময় বলে দিবে। গল্পের প্রয়োজনে যেকোনো চলচ্চিত্রে বা ওটিটি কন্টেন্টে রক্তপাত, যৌনদৃশ্য, চুমু তিনি আনতেই পারেন। পুরো গল্পের কন্টেক্সটে একে মূল্যায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র ওই অংশটুকু কেটে প্রচার করে পুরো ওয়েব সিরিজ বা গল্পকে খারিজ করে দেওয়া আর নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অন্যায়। আবার সব গল্পে যে এইসব দৃশ্য থাকবে তা নয়। সেটাও নির্মাতার স্বাধীনতা। পৃথিবীতে নানান ধরনের গল্প থাকবে। একেক গল্প বলার ঢং একেক রকম হবে। সব গল্প বলার ঢং যদি এক রকম হয়ে যায় তাহলে দর্শকও সেই সব গল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। যা আমাদের টেলিভিশনের সঙ্গে ঘটেছে বলে বেশ অনেক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে।
৯০ দশকের শেষে চলচ্চিত্রে কাটপিস সংযোজন সংস্কৃতির সঙ্গে। এই তুলনাটাই অবান্তর, কারণ কাটপিস সংযোজন করতেন প্রদর্শক বা হল মালিকরা স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার লোভে, যা নিজেই ছিল গর্হিত অপরাধ। নির্মাতা গল্প বলার জন্যে এসব করতেন না। কোনো নির্মাতা যখন সজ্ঞানে, গল্পের প্রয়োজনে তার মতো করে কোনো দৃশ্য ১৮+ দর্শকের জন্যে উপস্থাপন করেন, তার অন্তর্নিহিত ভাবকে না বুঝতে চেয়ে ঢালাওভাবে অশ্লীল বলে বানাতে না দিতে চাওয়া সেই নির্মাতার স্বাধীন ভাব প্রকাশের অন্তরায়। যদি সেই গল্প দর্শকের পছন্দ না হয় তাহলে দর্শকই তা বর্জন করবে। যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে। দিন শেষে দর্শকই ঠিক করবে সে পয়সা আর সময় খরচ করে কোন কন্টেন্ট দেখবে আর কোনটা বাতিল করে দিবে। বানানোর স্বাধীনতা যেমন নির্মাতার আছে, গ্রহণ বা বর্জন করার স্বাধীনতাও দর্শকের আছে। কিন্তু নির্মাতাকে বানাতে না দেওয়া আর সেটা দর্শক পর্যন্ত পৌঁছাতে না দেওয়া এই দুই শ্রেণিরই স্বাধীনতার লংঘন।
ডিজিটাল বাংলাদেশে পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও নেটফ্লিক্স, এমাজন প্রাইম, হৈচৈ, জি ফাইভ, মুবির মতো বিশ্বমানের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এসেছে। সেখানে সববয়সীদের জন্যে হাজার হাজার ১৮+, ১২+, ৭+, প্যারেন্টাল গাইডেন্স, জেনারেল কন্টেন্ট আছে এবং সাবস্ক্রাইব করে দর্শক তার চাহিদা অনুযায়ী দেখছেও। কই সেটা নিয়ে তো কোনো আপত্তি হচ্ছে না? ওরা কিন্তু বছরে ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করছে বিদেশি কন্টেন্ট দিয়েই। এখন সেই দর্শকদের জন্যেই আমরা যদি কোনো কন্টেন্ট তৈরি করতে চাই তাহলে বাধা দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত? নেটফ্লিক্স যদি আমাদের দেশের নির্মাতাদের দিয়ে কোনো সিনেমা বা সিরিজ বানাতে চায়, তারা তো গল্পের প্রয়োজনে যৌক্তিক যা দরকার তাই করতে চাইবে। সেখানে বাধা আসলে তারা আমাদের বাদ দিয়ে অন্য দেশের নির্মাতাদের দিয়েই বানাবে।
একটা বড় অভিযোগ এসব ওয়েব সিরিজ আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।
দেশের ১১৮ জন সুপরিচিত নির্মাতা এক বিবৃতিতে বলেছেন, "... আমাদের দেশে ওয়েব প্লাটফর্মে পথচলাটা যেহেতু খুব নতুন সেখানে প্রথমেই কোন বিচ্যুতি বা ভুলভাবে ব্যাখ্যা হবার কারণে যদি শুরুতেই এর চলার পথটা থমকে যায়, অথবা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীরা সাইবার বুলিং-এর শিকার হয় বা বৈচিত্র্যময় কন্টেন্ট নির্মাণের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তা বাংলাদেশের বিনোদন শিল্পের জন্য একটি বিরাট অন্তরায় হিসেবে দেখা দিবে"।
তারা বলেন, "টিভি বা ওয়েব সিরিজ যাই হোকনা কেন তার জন্য একটি স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ বাস্তবায়ন ও সেই সাথে পাইরেসি প্রতিরোধ করে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের কন্টেন্ট নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে পরিবেশনার ব্যাপারে একটি আধুনিক নীতিমালা করতে সরকার আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন এবং এই বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনৈতিক বিপ্লবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি করবেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি"।
অর্থাৎ তারা ওয়েব সিরিজগুলো নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে তার জন্য মূলত পাইরেসিকে দায়ী করেছেন।
এর মানে হলো সিরিজগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করা হলেও পেরে সেগুলো হ্যাকিং বা পাইরেসির শিকার হয়ে কিছু দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে যেগুলো অশ্লীল বলে মনে হচ্ছে অনেকের কাছে।
তবে দেশের সিনিয়র অভিনেতা অভিনেত্রীসহ ৭৯ জন আরেকটি বিবৃতিতে আরও কঠোর ভাষায় ওয়েব সিরিজ গুলোর সমালোচনা করেছেন।
তারা বলছেন, "অনেকদিন ধরে কিছু ইউটিউব এবং ওয়েব প্ল্যাটফর্মে অত্যন্ত দায়িত্বহীনতার সাথে কিছু নির্মাতা প্রযোজক, নাট্যকার ও অভিনয়শিল্পী কুরুচিপূর্ণ নাটক পরিবেশন করে আসছে। এই নাটকগুলির মধ্যে কাহিনীর প্রয়োজনে নয় একেবারেই বিকৃত রুচিসম্পন্ন নাটক নির্মাণ করে বিবেকবান ও সচেতন দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আমরা এহেন কাজকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করি, নিন্দা জানাই"।
এ ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেই। ৮০-র দশকের শেষে কিছু তরুণ যখন নিজেদের ঢং এ গান গাওয়া শুরু করল তখন সেই সময়ের সমাজেও গেল গেল রব উঠেছিল। বলা হয়েছিল এগুলো অপসঙ্গীত, অপসংস্কৃতি, চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়া কিছুই না। কিন্তু সেই ব্যাণ্ড সংগীত থেকেই আজকে আমরা পেয়েছি আজম খান, আইয়ুর বাচ্চু, মাকসুদ, জেমস, রেনেসাঁ, সোলস, মাইলস এবং আরও অনেককে। সেই সময় উনাদের গাইবার স্বাধীনতা হরণ করে দেওয়া হলে আজ আমরা তাদের মতো এবং তাদের পথ ধরে এত লেজেন্ডারি মিউজিশিয়ানদের পেতাম না। ব্যান্ড সংগীত এখন আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। ক্রিকেট কবে আমাদের সংস্কৃতি ছিল? আমরা তো আজীবন ফুটবল খেলে বড় হয়েছি। তাই বলে কি ক্রিকেটকে গ্রহণ করিনি? টেলিভিশন কবে আমাদের সংস্কৃতি ছিল? আমরা তো যাত্রা পালা আর জারি গানের জাতি ছিলাম। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, পাল্লা দেওয়ার জন্যে কি নানান এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে আমরা এদের গ্রহণ করিনি?
শিল্পী কে? যিনি আর দশজন সাধারণের মতো নিয়মের ঘেরাটোপে বন্দী না থেকে তার সৃষ্টিশীল কর্ম আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান সীমানাকে ক্রমশ প্রসারিত করেন। সেটা কবিতা লেখার মাধ্যমে হোক, উপন্যাস লেখার মাধ্যমে হোক, চিত্রশিল্পের মাধ্যমে হোক, কার্টুনের মাধ্যমে হোক বা ভিজ্যুয়াল/দৃশ্যকল্প নির্মাণের মাধ্যমে হোক। এখন আমরা যে পৃথিবী আর সমাজে বসবাস করছি ১০০ বছর আগে এই পৃথিবী বা সমাজ এইরকম ছিল না। সময় এবং নদীর স্রোত যেমন কারো জন্যে অপেক্ষা করে না, ঠিক তেমনি সমাজ এবং পৃথিবীও নানান ঘাত, প্রতিঘাত, নতুন নতুন ধ্যান ধারণা ও মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিজের বিনির্মাণ ঘটায়। ৫০ বছর আগে যে ব্যাপারগুলো অশ্লীল ছিল সেই ব্যাপারগুলোই আমাদের কাছে এখন স্বাভাবিক এবং সহজাত। একসময় এই সমাজে সতীদাহ সংস্কৃতিও চালু ছিল। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে এই প্রথা এখন বাতিল হয়ে গেছে। আমাদের ভরসা রাখতে হবে শিল্পীর স্বাধীনতার উপর। আমাদের সংবিধানও তার ৩৯ ধারায় বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতাকে রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। যদি সেই স্বাধীনতার মুক্তচর্চা করতে না দেওয়া হয় তাহলে আমরা কখনোই আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে পারব না।
"একটা নীতিমালা থাকা উচিত যে প্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য কিনা বা কোনটা ভায়োলেন্স বা ভূতের ছবি।এ ধরণের ক্যাটাগরি থাকলে সেটা সবার জন্য ভালো হবে। তা না হলে আমরা পিছিয়ে পড়বো ও নতুন এ সুযোগকে কাজে লাগানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে"।নীতিমালা হোক তবে সেটি যেন সেন্সর না হয়।মনে রাখতে হবে যে নেটফ্লিক্স আ্যামাজন সেন্সর করবেন কি করে।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: ইমরান খান
কার্যালয়: গ-১৩৩/৩, প্রগতি স্মরণী, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। মোবাইল: ০১৮৫৩-৫৪৬২৫৪
প্রিয়দেশ নিউজ কর্তৃক সর্বসত্ব ® সংরক্ষিত