পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ (ওআইসি)-এর পক্ষে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড, রোহিঙ্গাদের ধ্বংসসাধন, পাইকারি হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা, বসতভিটা থেকে তাড়িয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা করেছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কিছু অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ারও আবেদন জানিয়েছে গাম্বিয়া।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ রাখা এবং গণহত্যার সব ধরনের আলামত নষ্ট না করা।রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচারে গাম্বিয়াকে সব ধরনের সহযোগিতা আর সমর্থন দেবে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস।
১৯৭৮ সালে গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসমর্থন করে গাম্বিয়া, ১৯৫৬ সালে কনভেনশন অনুসমর্থন করেছিল মিয়ানমারও৷ কনভেনশনের নয় নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী যেকোনো পক্ষই গণহত্যা প্রতিরোধে বিচার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে৷ অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন- ওআইসির ৫৭ সদস্যের সমর্থনে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া এই মামলা দায়ের করেছে৷
গাম্বিয়ার অভিযোগ, বিয়ে ও সন্তান নেয়া, চলাচলসহ রোহিঙ্গাদের নানা মৌলিক অধিকার পরিকল্পিতভাবে হরণ করেছে মিয়ানমার৷ রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে আটে রাখা এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতেও সমর্থনের অভিযোগ আনা হয়েছে৷ গাম্বিয়া বলছে, এর সবকয়টিই ‘জেনোসাইডাল ইনটেন্ট’৷ ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭ সালের আগস্টে অভিযান চালিয়ে নারী ও শিশুসহ রোহিঙ্গা হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে৷
মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিচার আদালতে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করছে৷ দেশটির সেনাবাহিনী ‘তাতমাদো’ও সরকারের সমর্থনে কাজ করার কথা জানিয়েছে৷ দেশটিতে সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অ্যাকটিভিস্টদের প্রায়ই গ্রেপ্তার নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়৷ তারপরও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিচার আদালতের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন৷
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ দীর্ঘদিনের৷ কিন্তু গাম্বিয়া মামলা করার আগ পর্যন্ত মিয়ানমারকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি৷ এই মামলা শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে৷ এ কারণে মামলা শেষ হওয়ার অন্তর্বর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে গাম্বিয়া বিচার আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছে৷ এ সংক্রান্ত নির্দেশনা খুব দ্রুতই আসতে পারে৷
চাইলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া, নাগরিকত্ব দেয়া, বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন, মানবাধিকারকর্মীদের প্রবেশ নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ যেকোনো আদেশ দিতে পারে বিচার আদালত৷
বিচার আদালতের আদেশ মানতে সব পক্ষই বাধ্য৷ পাশাপাশি আদালতের সব আদেশের কপি পাঠানো হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে৷ চাইলে জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থাও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে৷ অভিযোগ প্রমাণিত হলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় প্রশ্নের মুখে পডৃ়তে হতে পারে মিয়ানমারকে৷ পাশাপাশি রায় না মানলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়তে পারে৷
বিভিন্ন দেশে বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকা ১৫ জনকে নিয়ে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের বেঞ্চ৷ তবে মামলার কোনো পক্ষ চাইলে অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন বিচারক নিয়োগের আবেদন করতে পারে৷ সাউথ আফ্রিকার জুরি ড. নাভানেথেম পিললায়কে বিচারক নিয়োগ দিয়েছে গাম্বিয়া৷ তিনি রুয়ান্ডা গণহত্যা ট্রাইব্যুনালের বিচারক ছিলেন৷ মিয়ানমারের নিয়োগ পেয়েছেন জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লাউস ক্রেস৷
২০০৭ সালে বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনার স্রেব্রেনিকায় সার্বিয়া গণহত্যা চালিয়েছে বলে রায় দেয়৷ একই সঙ্গে বসনিয়ার সার্ব জেনারেল রাতকো ম্লাদিচকে গ্রেপ্তার ও হস্তান্তর না করে সার্বিয়া গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে বলেও রায়ে বলা হয়৷ শেষ পর্যন্ত ম্লাদিচকে ২০১১ সালে ইয়ুগোস্লাভ ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় সার্বিয়া৷
নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর অনুমতি দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত- আইসিসি৷ বাংলাদেশ ২০১০ সালে আইসিসির সদস্য হলেও মিয়ানমার সদস্য নয়৷ নভেম্বরেই আর্জেন্টিনার আদালতে রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে একটি তদন্ত দল গঠন করে৷ তবে এই দলকে সহযোগিতা না করার ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার৷
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্য়র্থ হয়েছে মিয়ানমার৷ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে৷ কিন্তু এরপর রোহিঙ্গা গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়াসহ গণহত্যার সব প্রমাণ মুছে ফেলার অভিযোগ আসে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে৷ ইন দিন গ্রামে গণহত্যায় জড়িত থাকা সাত সেনাসদস্যকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হলেও মাত্র সাত মাস পর তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়৷
মিয়ানমারের ঘটনায় ১৩ নভেম্বর আরেকটি মামলা করা হয়েছে আর্জেন্টিনার একটি আদালতে।বিভিন্ন মানবাধিকার গ্রুপ ও রোহিঙ্গা সংগঠন কর্তৃক দায়ের করা এ মামলায় ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সঙ্গে অং সান সু চিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই মামলায় সু চির এক্সট্রাডিশন (প্রত্যর্পণ) চাওয়া হলে তাঁর আন্তর্জাতিক গতিবিধি সীমিত হয়ে যাবে। এশিয়ার ম্যান্ডেলা থেকে তিনি পরিণত হতে পারেন আন্তর্জাতিক ফেরারিতে।
গাম্বিয়ার রাষ্ট্রীয় নাম গাম্বিয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র। পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র, এটি আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখন্ডের ক্ষুদ্রতম দেশ। এর উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সেনেগাল দ্বারা পরিবেষ্টিত। পশ্চিমে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর। গাম্বিয়া নদী দেশটির মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে।বন্দর শহর বানজুল দেশটির রাজধানী আর সেরেকুন্দা দেশের বৃহত্তম শহর।
গাম্বিয়া একটি কৃষিপ্রধান দেশ, প্রধান ফসল বাদাম। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র।পর্যটন শিল্প থেকেও আয় হয়। আটলান্টিক সাগরের উপকূলের সমুদ্রসৈকতগুলোতে ঘুরতে এবং গাম্বিয়া নদীর বিচিত্র পাখপাখালি দেখতে পর্যটকেরা গাম্বিয়ায় যান।
গাম্বিয়া ১৯শ’ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৬৫ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর দেশটি একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৯৪ সালে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হয় এবং সামরিক নেতা ইয়াহিয়া জাম্মেহ ক্ষমতা দখল করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশটি শাসন করেছেন। এর পর থেকে আদামা বারো দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গাম্বিয়ার জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ ভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী।মুসলিমদের পাশাপাশি দেশটিতে রোমান ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের খ্রিস্টানরাও বসবাস করেন।
২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর দেশটিকে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাম্মেহ এ ঘোষণা দেন। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হলে দেশটিতে অন্য ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মকর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবেন।
গাম্বিয়ায় কর্মস্থলে নারীদের চুল খোলা রাখা নিষিদ্ধ।রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষায় গাম্বিয়ায় নাচ-গান এবং ড্রামসহ সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষিদ্ধ।
গাম্বিয়াতে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন মসজিদ রয়েছে।কিং ফাহাদ মসজিদ গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুলের অন্যতম প্রধান মসজিদ। মসজিদটি ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয়।গাম্বিয়ার প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় ১৯৩০ সালে।এ ছাড়া রাজধানী বানজুল,সেরেকুন্দা ও ডেম্বাকুন্দা শহরেও বেশ কিছু মসজিদ রয়েছে। বেশিরভাগ মসজিদ বিভিন্ন মুসলিম দেশের অর্থায়নে নির্মিত।
গাম্বিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম থেকেই কোরআন ও ইসলাম শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে ইসলামকে প্রাধান্য দিয়ে। প্রায় প্রতি পরিবারে রয়েছে কোরআনের হাফেজ। বাচ্চাদের কোরআন শিক্ষা দেওয়া তাদের ঐতিহ্যের অংশবিশেষ। কোরআনিক স্কুলে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করে বেশ গুরুত্ব দিয়ে।
মামলা নিঃসন্দেহে বিরাট কূটনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে মিয়ানমারের শাসক ও সামরিক বাহিনীর ওপর। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তিতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এ সময়ে মিয়ানমারে প্রায় বন্দিদশায় থাকা ৪ লাখ এবং বাংলাদেশে বিতাড়িত ১০ লাখ রোহিঙ্গার মানবাধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নটি ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তোলার মধ্যেই এ সংকটের প্রকৃত সমাধান নিহিত।দায়ের করা মামলাগুলো সুযোগ করে দিয়েছে এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বেগবান করার।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: ইমরান খান
কার্যালয়: গ-১৩৩/৩, প্রগতি স্মরণী, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। মোবাইল: ০১৮৫৩-৫৪৬২৫৪
প্রিয়দেশ নিউজ কর্তৃক সর্বসত্ব ® সংরক্ষিত