রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক ‘মো: শাহেদের ‘দুবৃত্তপনা’

রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অনিয়ম এবং প্রতারণার অভিযোগে সোমবার র‌্যাবের একটি দল উত্তরায় অবস্থিত হাসপাতালের একটি শাখায় অভিযান চালায়। সেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষা না করেই ভুয়া সনদ দেয়াসহ নানা ধরণের অনিয়মের প্রমাণ পায় র‍্যাব।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়া, “রোগীদের কাছ থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় টেস্টের জন্য তারা দুইবার অর্থ নিত। এছাড়া এ হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবার কথা থাকলেও, প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে বেড ও অক্সিজেন সিলিন্ডার বাবদ বিপুল অর্থ বিল করত,”

বাংলাদেশে মার্চ মাসে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হবার পর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সংগ্রহ ও বিতরণ নিয়ে নানা ধরণের অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

অনিয়মের অভিযোগে হাসপাতালের উত্তরা শাখা সিলগালা করে দেয় র‍্যাব। একই দিন রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর এবং উত্তরা দুইটি শাখারই কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

এসব প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো: শাহেদ আত্মগোপনে গেছেন বলে পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাব জানিয়েছে।

র‍্যাব বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, তার বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একইসাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, মো: শাহেদ দেশের ভিতরেই পালিয়ে রয়েছেন।

মো: শাহেদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা এবং দুর্নীতির তদন্ত করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।কিন্তু অভিযোগ ওঠার দু’দিন পরও তাকে যে গ্রেফতার করা যায়নি, সে ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার কর্মীদের অনেকে।

রিজেন্ট হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম শিবলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে। তাকে হাসপাতালটির মালিক মো: শাহেদের সহযোগী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে র‍্যাবের পক্ষ থেকে।

গত দু’দিনে আরও ৭জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই গ্রেফতারকৃতদের সকলেই হাসপাতালটির কর্মকর্তা-কর্মচারী।

র‍্যাব বলছে, রিজেন্ট এ পর্যন্ত সাড়ে চার হাজারের বেশি ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে, এবং ২০১৪ সালে লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পর আর নবায়ন না করেই তারা হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

এর মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি অভিযোগ করে, হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে অনিয়ম থেকে শুরু করে এন-৯৫ মাস্কসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এখন র‍্যাব বলছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ দিনের পর দিন অনিয়ম চালিয়ে গেছেন।

কিন্তু মার্চের ২১ তারিখে যখন এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর কোভিড-১৯ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার জন্য চুক্তি করে, তখন হাসপাতালটির বৈধ লাইসেন্স, জরুরি চিকিৎসা সেবা দেয়ার সক্ষমতা কিংবা পূর্ববর্তী রেকর্ড কোন কিছুই পর্যালোচনা করা হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, সরকার একটি জরুরি পরিস্থিতিতে হাসপাতালটির সঙ্গে চুক্তি করেছিল, যে কারণে তখন অনেক কিছু যাচাই করে দেখা হয়নি।

“যখন রোগীর অনেক চাপ, সেসময় বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন, জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে সে সময় তার সাহায্যকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। সেজন্যই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে উপস্থিত ছিলেন।

“কিন্তু কার ভেতরে কী আছে, সেটা তো শুরুতে জানা যায়নি। যারা দুর্বৃত্ত তারা নানাভাবে ভালো জায়গায় ঢুকে ‘দুর্বৃত্তপনা’ করেন। আমাদের সাথেও জরুরি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি (রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক) ‘দুবৃত্তপনা’ করেছেন,” বলছেন নাসিমা সুলতানা।

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, মহামারি শুরুর পর থেকে স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনায় সরকারের দুর্বল নজরদারির কারণে এ ধরণের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।

এর আগেও মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর আগে পরীক্ষা না করেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সনদ দেবার অভিযোগ ওঠে জেকেজি নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলছেন, এক্ষেত্রে সরকারি মনিটরিং-এর অভাবের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতি করা হয়েছে।

“কোভিড-১৯ মোকাবেলায় শুরু থেকে সরকার বলেছে তারা কমিটি করেছে, সরকারের সুপারভিশন বাড়ানো হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি, হলে এ ধরণের দুর্নীতির ঘটনা ঘটত না,” তিনি বলেন।

”একদিকে সরকারের সুপারভিশনের অভাব রয়েছে, একই সঙ্গে রিজেন্টের পক্ষ থেকেও এই জরুরি পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ‘অনৈতিক’ একটি কাজ করা হয়েছে।”

অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা মনে করেন, এ ধরণের দুর্নীতি আটকাতে না পারলে মহামারি মোকাবেলায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে জনমনে। সেক্ষেত্রে এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নেবার পরামর্শ দেন তিনি।

কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য শুরুর দিকে সরকারের নির্ধারিত বেসরকারি হাসপাতালের অন্যতম এই রিজেন্ট হাসপাতাল। চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগে র‍্যাবের মামলায় এই গ্রেফতারকৃতরাও অভিযুক্ত রয়েছেন। কিন্তু মূল অভিযুক্ত মো:শাহেদ এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।

মো: শাহেদ বিভিন্ন সময় শাহেদ করিম নাম ব্যবহার করেছে বলে র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেছেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মো: শাহেদকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

“শাহেদ করিমকে গ্রেফতারের জন্য আমরা সর্বাত্নকভাবে অভিযান পরিচালনা করছি। তাকে ধরার জন্য সারাদেশেই র‍্যাব সজাগ আছে। সে যেন কোনভাবেই দেশ ত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য র‍্যাব সতর্ক অবস্থায় আছে।”

তিনি আরও জানিয়েছেন যে, প্রতারণার মামলার তদন্তের দায়িত্ব যেন র‍্যাব পায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তারা সেই অনুরোধ জানাবেন।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রিজেন্ট হাসপাতাল এবং মো: শাহেদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পদক্ষেপ নিয়েছে গোয়েন্দা শুল্ক বিভাগ।

এখন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকও মো শাহেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর কথা বলেছে। দুদকের সচিব দিলওয়ার বখত বলেছেন, দুর্নীতির বিষয়ে তারা অনুসন্ধান করবেন।

চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগে দেশে আলোচনার শীর্ষে থাকা মো: শাহেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে যে খুঁজে পাচ্ছে না-এনিয়েও নানা আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মীদের অনেকে মো: শাহেদকে গ্রেফতারের প্রশ্নে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান বলেছেন, মো: শাহেদকে ধরা যাচ্ছে না- এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।

“হাসপাতালের কয়েকজনকে ধরেছে। কিন্তু মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না-এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করছি না। কারণ করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া বেশ কঠিন।”

এলিনা খান মনে করেন, করোনাভাইরাসের ভুয়া পরীক্ষার জন্য কেউ মারা গেছে কিনা বা সংক্রমণ কতটা ছড়িয়েছে- মো: শাহেদ এবং রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারেও তদন্ত করা উচিত।

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মো: শাহেদ দেশের ভিতরেই পালিয়ে রয়েছেন এবং তাকে গ্রেফতারের জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান অব্যাহত রেখেছে।