একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে করা যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ বলায় দৈনিক সংগ্রাম অফিসে ভাঙচুর, সম্পাদককে হেনস্তার পর ডাকসু ভবনে হামলা ও ভিপি নুরসহ তার সংগঠনের বহু নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালানোর পর নতুন করে আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন। ইতোমধ্যে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকসহ একাধিক নেতাকর্মীর রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এসব ঘটনা, আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের এই সংগঠনের পেছনে আসলে কারা রয়েছে? এই সংগঠন কবে প্রতিষ্ঠিত হলো? আর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যইবা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে প্রিয়দেশ নিউজ।
প্রিয়দেশ’র অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৪ মাস আগে এই সংগঠনের জন্ম হয়। কোনো গঠনতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় যাকে খুশি তাকে পদ দিয়ে সংগঠনের নেতা বানানো হয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পর গত অক্টেবরে শাহবাগ এলাকায় টানা এক মাস অবস্থান করে প্রথমে আলোচনায় আসে তারা। কোটা বহালের দাবিতে ছিল তাদের আন্দোলন। ভিপি নুরদের সাথে ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথেও তাদের সংঘর্ষ হয়েছে।
কথিত এই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ পরিচালানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন নেতা কর্মী। প্রথমে এই মঞ্চের মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের ছেলে হাসিবুর রহমান খান।
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কবি জসীমউদ্দীন হলের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।
গত ১০ অক্টোবর নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের কারণে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির বহিষ্কৃত সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম ও ছাত্রলীগের সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক আল মামুন মূল সংগঠন থেকে বেরিয়ে নিজেদেরকে একাংশের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করেন। তারা নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে আলাদা কমিটি গঠন করে। এরপর দুই পক্ষ পরস্পরকে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার করে। তাদের দুই পক্ষের দাবি তারাই এখন প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধা মঞ্চ।
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের শেষ কর্মসূচি ছিল ১০ অক্টোবর। সেদিন মঞ্চে অধ্যাপক জামাল উপস্তিত ছিলেন না। সেদিন দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজু ভাস্কার্যের সামনে যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন আমিনুল ইসলাম ও আল মামুন। এই কর্মসূচির পর রাতে মঞ্চ থেকে আমিনুল ইসলাম ও আল মামুনকে অব্যাহতি দেন অধ্যাপক জামাল। সেই রাতে অধ্যাপক জামালকে উপদেষ্টা আর নিজেদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন আমিনুল ইসলাম ও আল মামুন। সেই ১০ অক্টোবর রাতেই আবার আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে অধ্যাপক জামালকে উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথাও জানান তারা।
গত ৪ অক্টোবর সংগঠনের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আলোচনা সভা শেষে রাতে ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। এই অনুষ্ঠানের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রকশনের কাছ থেকে জামাল উদ্দিন এক লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন: ফোনে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে তমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন জামাল। কিন্ত একটি বিলও পরিশোধ না করে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সেই আয়োজনে সতের জন কর্মচারী নিয়ে কাজ করেন ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার বাবুর্চি সেলিম গাজী। এতে খাবার ও কর্মচারীদের পারিশ্রমিক বাবদ ৩৯ হাজার ৮২০ টাকা না পাওয়ার কারণে অধ্যাপক জামালের বিরুদ্ধে ১৭ অক্টোবর প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সেলিম গাজী।
এ বিষয়ে অধ্যাপক জামাল বলেন: এই অভিযোগ সম্পূণ ভিত্তিহীন। আমার কাছে কেউ কোনো টাকা পাবে না। তবে তমা কনস্ট্রাকশন স্বেচ্ছায় আমাদের কিছু টাকা দিয়েছেন এতে কোনো রকম তাদেরকে চাপ দেওয়া হয়নি।
আল মামুনের অভিযোগ: চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের কারণে তারা অধ্যাপক জামালকে মঞ্চ থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি যুবলীগের বিতর্কিত চেয়ারম্যানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তার কাছ থেকে টাকা খেয়ে।
অধ্যাপক জামাল বলেন: আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করি, এতে চাঁদাবাজির প্রশ্নই আসে না।
জামালের পক্ষে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মিজানুর রহমান। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক পরিবেশ বিষয়ক উপসম্পাদক। ২০১৭ সালের ৬ আগস্টে দুই জন ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
অন্য পক্ষে থাকা আমিনুল ইসলামকে সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে।