ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে সবচেয়ে বেশী ব্রিটিশবাংলাদেশীদের বসবাস হলেও বর্তমানে বাড়ীর দাম বৃদ্ধি, বাসা ভাড়া বেড়ে যাওয়া ও কাউন্সিলর বাসা সহজলভ্য না হওয়া সহ নানা কারণেই অনেকে লন্ডন ছাড়ছেন।
বসত করছেন মানচেষ্টার স্কানথপ, বার্মিংহাম ও নর্থাম্পটন সহ বিভিন্ন শহরে। লন্ডন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ টি বাংলাদেশী পরিবার নর্থাম্পটনে এসে বসবাস করছেন।
সিলেটে লন্ডন মানেই বিলেত এক সময় মুখে মুখে এটাই ছিল পরিচয়,পরিচিত। মুখের সুরে বিলেতের চেয়ে লন্ডনের নাম ধাম বলা বাহুল্য, ৫০শের দশকে সিলেটি বিলেত মুখি হতে থাকলেন, স্থানীয়ভাবে তাদের লন্ডনী ভাইসাব বলেই ডাকা হতো, আজও চলছে একই নামে-ডাকে।
কিন্তু যে লন্ডনে সিলেটীরা আদি বাড়ী গড়েছিলেন, সুখের আর সুযোগ সুবিধার আশায়, তা নিয়ে হাফিয়ে উঠছেন সিলেটের লন্ডনীরা। জীবনমানের চরম তাপে আর মানিয়ে নিতে পারছেন না লন্ডনে বসবাস করার স্বাধ । তাই লন্ডন ছাড়ার প্রবণতা লক্ষনীয় হয়ে উঠেছে । বাড়ি কেনা এখন সোনার হরিণ যেন।
আর কাউন্সিলের ভাড়া বাড়ি তাও দিবা স্বপ্ন ! যদি কপালে জুটে যায়, কিন্তু বাড়ার চড়া তেজে হিমশিমে খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেকারনে চোখ কান খুলা রাখছেন কোথায় আয়ের সাথে ব্যয় সামলে চলা যাবে একটু হলেও আরামে।
সুযোগ পেলেই দে ছুট অবস্হা এখন অনেকের মধ্যে। তুলনামুলক লন্ডনের চেয়ে কম দামে বাড়ি কেনার সুযোগ মিলছে বৃটেনের অন্যান্য শহরে। তেমনি একটি শহর নর্থাম্পটন।
এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন বিট্রিশ বাংলাদেশী লন্ডন থেকে চলে এসেছেন এই শহরে।এখানে ভালোই আছেন তারা। স্বাধ আর সাধ্যের মাঝেই পার করছেন জীবনের চাওয়া পাওয়া। গত আড়াই বছর ধরে এই শহরে বসবাস করে চলছেন ফাতেহ আলী। একই ভাবে রয়েছেন ফিরোজ মিয়া সহ আরও অনেকেই।ফিরোজ মিয়া বললেন,লন্ডন ছেড়ে এসে খুব ভালো লাগছে।এখানে বাড়ির দাম ও লন্ডনের চেয়ে কম।
যোগাযোগের ভালো জায়গা তাই এই শহরে এসেছি। ফাতেহ আলী বলেন,লন্ডনের বাড়ি ভাড়া খুব বেশী। কাউন্সিলর বাড়ি পাওয়া যায় না।তাই এসেছি। যারা এই শহরে এসে আশাহত না হয়ে ভিন্ন এক আমেজে চাপমুক্ত ভাবে জীবন ধারায় গতি নিয়ে বসবাস করছেন।
উল্ল্যেখ্য যে, প্রায় ৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশির বসবাস এখন ব্রিটেনে।যা তাদের মোট জনসংখ্যার ০.৭১ ভাগ। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৫১ হাজার ৫ শ ২৯ জন । এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এই কয়েক বছরে এ সংখ্যা বেড়ে প্রায় ছয় লক্ষ হয়েছে এবং এর ৯৭ ভাগই সিলেটি।
১৯৬১ সালের প্রথম আদমশুমারিতে স্থান পাওয়া বাংলাদেশী সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ হাজার। সময়ের পরিবর্তনে তা বেড়ে দাড়িয়েছে আজ প্রায় ৬ লক্ষতে। ব্রিটেনে বাংলাদেশীরা গড়ে তুলেছেন আরেক খন্ড বাংলাদেশ। শত বছর যাবত গৌরবের সাথে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা ব্রিটেনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৪০। এই সংখ্যা ২০০৮ সালের তুলনায় ২৩১ শতাংশ বেশি। নাগরিকত্ব দেয়ার হিসাব ১৯৬২ সাল থেকে প্রকাশ করা শুরু করে ব্রিটেন। ২০০৯ সালে দুই লাখেরও বেশি বিদেশী আবেদনের মাধ্যমে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন।
এটি ব্রিটেনের সর্বকালের রেকর্ড। ২০০৯ সালে নাগরিকত্ব পাওয়াদের ৫০ শতাংশ পেয়েছেন দীর্ঘ সময় ব্রিটেনে বসবাসের সূত্রে। ২৫ শতাংশ পেয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিককে বিয়ে করার সূত্রে। বাকি ২৫ শতাংশ শিশু।
জানা যায়, ১৮৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালাতে সর্ব প্রথম কয়েকজন সিলেটি রন্ধনশিল্পীকে নিয়ে আসে ব্রিটেনে। আর এরাই ছিলেন ব্রিটেনে প্রথম আসা কোন বাংলাদেশী। পরবর্তিতে ১৯২৫ সালে এই কয়েকজন রন্ধনশিল্পীদের বদৌলতে তাদের আত্বীয়স্বজনরা আসেন ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল এই দশ বছরে বাংলাদেশী বড় একটি অংশ ব্রিটেনে প্রবেশ করে।
পূর্বে ব্রিটেনে আসা বর্তমান সময়ের মতো এতটা কঠিন ছিলনা। তারপরও বংশানুক্রমে আজ অবধি ব্রিটেনে উন্নত জীবন যাপনের উদ্দেশ্য আসছেন বাংলাদেশীরা।
ব্রিটেনের সবগুলো শহরেই এখন বাংলাদেশীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এর মধ্য সবচেয়ে বেশি আছেন ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে। ২০১১ সালের ন্যাশনাল অফিস ফর স্টাটিক্স এর জরিপে দেখা যায়, লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় রয়েছেন ২ লক্ষ ২২ হাজার ১২৭ জন বাংলাদেশী, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫২ হাজার ৪শ ৭৭ জন বাংলাদেশী আছেন বার্মিংহামে।
এছাড়া ওল্ডহামে আছেন ১৬ হাজার ৩শ, লুটনে আছেন ১৪ হাজার ৭শ, ব্রাডফোর্ডে আছেন ১১ হাজার ৯শ বাংলাদেশী। এছাড়া মানচেষ্টার, নিউক্যাসল, কার্ডিফ এবং সেন্ডারল্যান্ডসহ ব্রিটেনের প্রায় প্রত্যেক শহরেই বাংলাদেশীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ইস্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে বর্তমান সংখ্যা ৩ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে এর সটিক হিসাব আগামী ২০২১ সালের আদমশুমারিতে পাওয়া যাবে।
১৯৬১ সালে প্রথম আদমশুমারিতে বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৬ হাজার, ১৯৭১ সালে ২২ হাজার, ১৯৮১ সালে ৬৪ হাজার ৫শ ৬১ জন, ১৯৯১ সালে ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৮ শ ৩৫ জন, ২০০১ সালে ২ লক্ষ ৮৩ হাজার ৬৩ জন ও সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এ সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৫১ হাজার ৫শ ২৯ জন। এদের মধ্য অর্ধেকের ও বেশি যারা জন্মসুত্রে বাংলাদেশী।
ব্রিটেনে যে কেউ ৫ বছর পর্যন্ত থাকলে পরবর্তিতে তিনি নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। প্রায় শত বছর ধরে আসা বাঙালিরা ব্রিটেনের সব পর্যায়ে অত্যন্ত গৌরবের সাথে নিজেদের তুলে ধরেছেন।
তাদের মধ্য উল্লেখযোগ্যরা হলেন, হাউস অফ কমন্সের এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক, টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক মেয়র লুতফুর রহমান, সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনওয়ার চৌধুরী, লেবার পার্টির বিশিষ্ট রাজনৈতিক পলা মনজিলা উদ্দিন, শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ বারি, ব্রিটিশ সঙ্গীত শিল্পী মামজী, ব্রিটিশ সেলিব্রিটি কনি হক, নভেলিস্ট কিয়া আব্দুল্লা, ভাষাবিদ ওয়ালী তছর উদ্দিন সহ আরো অনেকে। ব্রিটেনে প্রতিটি বাংলাদেশী আজ দেশের সুনাম বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের প্রেরিত রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
ব্রিটেনে ২৪ বছর যাবত স্থায়ী বসবাসকারী দয়ামীর ঘোষগাও গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মফিদুল গনি মাহতাব বলেন, ব্রিটেনে আজ আমরা ৬ লক্ষ বাংলাদেশী ভাবতে ভালো লাগছে, একেকজন বাংলাদেশী বিদেশের মাটিতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রেমিটেন্স পাঠিয়ে রাখছেন দেশের অর্থনীতিতে বিড়াট ভুমিকা।
ব্রিটেনের প্রত্যকটি জায়গায় সুনামের সাথে নিজেদের জায়গা করে নেওয়া স্বদেশীদের নিয়ে আমরা গর্বিত। আমাদের নতুন প্রজন্ম আজ এদেশে ডাক্তার, আইটি ম্যানেজম্যান্ট স্পেশালিষ্ট, শিক্ষকতা এবং তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায় সফলভাবে বিচরন করছে। বাংলা ভাষায় অসংখ্য প্রিন্ট মিডিয়া আর বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া রয়েছে ব্রিটেনে। যা একসময় ছিল না আমরা তার বড়ই অভাব অনুভব করতাম। তারা আজ দেশীয় সংস্কৃতি আর দেশকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে রাখছেন বড় ভুমিকা।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: ইমরান খান
কার্যালয়: গ-১৩৩/৩, প্রগতি স্মরণী, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। মোবাইল: ০১৮৫৩-৫৪৬২৫৪
প্রিয়দেশ নিউজ কর্তৃক সর্বসত্ব ® সংরক্ষিত