
সুপ্রিম কোর্টের অধীনেই বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় হচ্ছে। যা সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় নামে অভিহিত হবে। এই সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রধান বিচারপতির হাতে। তবে সরকারের কোন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তরের আওতাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়। সচিবালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় অনুমোদনে প্রধান বিচারপতিকে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে এ সংক্রান্ত খসড়া প্রণয়ন করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রণীত এই খসড়ার ওপর ইতিমধ্যে মতামত দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ঐ মতামত পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ নামে খসড়াটি চূড়ান্ত করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
খসড়াটি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পরই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারি হবে। তবে বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের কারণে অধ্যাদেশ জারির প্রক্রিয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয় মনে করছে বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল থাকাবস্থায় বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার আইন করা হলে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এমন পরিস্থিতি এড়াতেই সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের সংশোধন বা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল হলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয়।
তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল থাকলেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় অধ্যাদেশ জারি করতে আইনগত বাধা নাই। এ প্রসঙ্গে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. মাসদার হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই বাধা নয়। কারণ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের আলোকেই এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠার গেজেট জারি হবে। ১১৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নাই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আপাতত দৃষ্টিতে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও সংবিধানের মূলমন্ত্র বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকেই বাস্তবায়িত করবে। এটার সঙ্গে সংবিধানের কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক হবে না।
প্রসঙ্গত: সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল -নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান {রাষ্ট্রপতির} ওপর ন্যস্ত থাকিবে।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের ফলে বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি নির্বাহী বিভাগের আওতায় থেকে গেছে। এসব কাজ রাষ্ট্রপতির পক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক প্রযুক্ত হয়। একইভাবে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয় এই দুটি কর্তৃপক্ষের যুগপৎ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা দ্বৈত শাসনের অংশ হিসেবে বিচার কর্ম বিভাগের সকল বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তথা সরকারের ওপর নির্ভরশীল।
এদিকে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের কারণে বিচার বিভাগে যে দ্বৈত শাসন চলে আসছে তার অবসান হওয়া দরকার বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। গত ২১ সেপ্টেম্বর দেওয়া অভিভাষণে তিনি বলেন, সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে অধস্তন আদালতের বিচারকগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান না হয়। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এক্তিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এ বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে স্পষ্টত সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা পরামর্শমূলক। সুতরাং বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মূলনীতি বাস্তবায়ন করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শকের ভূমিকার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে।
খসড়ায় যা আছে:
খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশের বিচার প্রশাসন পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা প্রদান করার লক্ষ্যে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল এর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সকল সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়। এই সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হবেন সচিব। যিনি বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত অধস্তন আদালত বা ট্রাইব্যুনালের বিচারক বা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের কোন সদস্য। তিনি সরকারের সিনিয়র সচিবের সমমর্যাদা ও সুবিধাদি ভোগ করবেন। অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় ছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সকল আদালত বা ট্রাইব্যুনাল এর চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ করবে। সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন সাপেক্ষে রাজস্ব আদালতসমূহ ব্যতীত হাইকোর্ট বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের সকল অধস্তন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা, এক্তিয়ার, ক্ষমতা ও গঠন নির্ধারণ করবে। অধস্তন আদালত ও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের বাজেট ব্যবস্থাপনা, অধস্তন আদালত এবং বিচারকগণের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান করবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে রিট মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়
আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন অ্যাডভোকেট মো. শিশির মনির। গত বছর দায়েরকৃত ঐ রিটের ওপর রুল জারি করে হাইকোর্ট। রুলে বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। জারিকৃত রুলটি এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এই রিট মামলায় যদি হাইকোর্ট আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় তাহলে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করতে আইনগত যে বাধা তা দূর হবে জানান আইনজ্ঞরা। আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকিবে।’