প্রয়ানে কণ্ঠশিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোর

7

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর আর নেই। অসংখ্য ভক্তদের কাঁদিয়ে আজ সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি(ইন্নালিল্লাহে…রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিলো ৬৪ বছর। নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোর মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৪। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে গেছেন। প্রথম সন্তানের নাম সংজ্ঞা আর দ্বিতীয় জনের নাম সপ্তক।

তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এক শেকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেছেন, এন্ড্রু কিশোর তার গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে।রাজশাহীতে তার বোনের বাড়িতে সন্ধ্যে সাতটার দিকে অ্যান্ড্রু কিশোর মারা যান বলে বোনের স্বামী ডা. প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস নিশ্চিত করেন।

সিঙ্গাপুরে কয়েকমাস চিকিৎসার পর গত মাসের ১১ তারিখ অ্যান্ড্রু কিশোর দেশে ফেরেন। পরপরই তাকে রাজশাহীতে তার ডাক্তার বোনের বাড়িতে নেওয়া হয়। এই ডাক্তার দম্পতি বাড়িতেই তার চিকিৎসা করছিলেন।

৮০ দশক থেকে শুরু করে টানা এক যুগের বেশি সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গানের জগতে রাজত্ব করেছেন অ্যান্ড্রু কিশোর।

এন্ড্রু কিশোরের জন্ম ১৯৫৫ সালে; ছোট বেলা থেকেই সঙ্গীতে অনুরক্ত ছিলেন তিনি। রজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়াশোনা করেছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্র রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন।এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে; মেইল ট্রেন চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। এরপর বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীতেও কণ্ঠ দেন তিনি। ১৯৭৯ সালে প্রতিজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গান গাওয়ার পর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে; কিন্তু এক পর্যায়ে সেখানকার চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিলে গত ১১ জুন ফিরে আসে দেশে।

সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাতান এলাকায় বোন ডা. শিখা বিশ্বাস ও ভগ্নিপতি ডা. প্যাট্রিক বিপুলের বাসায় ছিলেন এন্ড্রু কিশোর।

প্যাট্রিক বিশ্বাস ক’দিন আগেই গ্লিটজকে জানিয়েছিলেন, এন্ড্রু কিশোরের শারীরিক অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। লিম্ফোমা ফিরে আসায় তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। তার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আর উপায় নেই।

তার শেষ দিনগুলো নিয়ে স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু রোববার রাতে স্বামীর ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন, “এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব, বলে, ‘কিছু না, পুরনো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয় না’।”

লিপিকা লিখেছেন, “ক্যানসারের লাস্ট স্টেজ খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।”

স্বামীকে নিয়ে লিপিকা আরও লেখেন, “এটাই শেষ পোস্ট, এর পর আর কিছু বলা বা লেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না, অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না।”

করোনাভাইরাস সঙ্কটকালে সবাইকে সাবধান থাকার পরামর্শও দেন তিনি।

“এই অসময়ে সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন আর এন্ড্রু কিশোরের প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।”

বেশ কিছু দিন অসুস্থ থাকার পর এন্ড্রু কিশোরের ক্যান্সার ধরা পড়ে। গত বছর সিঙ্গাপুরে যান চিকিৎসার জন্য।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর।

চিকিৎসা শেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ১১ জুন তার দেশে ফেরার কথা থাকলেও ১০ জুন এক পরীক্ষায় তার শরীরে আবারও লিম্ফোমার অস্তিত্ব মিলে। ফলে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দেন।

তখনকার ঘটনা তুলে ধরে লিপিকা এর আগে বলেছিলেন, “আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বরকে ডেকেছি। কারণ শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, লিম্ফোমা যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি ব্যাক করে তাহলে সেটা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসে। আর খুব দ্রুত ছড়ায়। কোনোভাবেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

“কিশোর আমাকে বলল, ‘ডাক্তারকে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরব’। আমি ভয়ে চুপ করে বসে আছি, শুধু বললাম দেখি ডাক্তার লিম কী বলে। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বলল ডাক্তার ডাকছে। লিম আমার সামনে এসে একটাই কথা বললো, ‘লিম্ফোমা ব্যাক করেছে।”

লিপিকা তখন লিখেছিলেন, “চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে ডাক্তারকে বললাম, ‘হোয়াট নেক্সট?’ ডাক্তার বললেন, ‘আই অ্যাম স্যরি, আমার আর কিছুই করার নাই।’

“আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ডাক্তার কিশোরকে বলে, লিম্ফোমা ফিরেছে। কিশোর ডাক্তারকে বলে, ‘তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কালই দেশে ফিরব’।

“আমাকে বলে, ‘আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি তো কাঁদছি না, তুমি কাঁদছ কেন?’ কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর তখনই বাংলাদেশ হাই কমিশনে ফোন করে বলে, ‘কালই আমার ফেরার ফ্লাইট ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে।’

তিনি বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। যেজন্য তিনি ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যে খানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, সবাই তো ভালোবাসা চায় প্রভৃতি।বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবদানের জন্য তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিএ পুরষ্কার  লাভ করেন।