সরকারের প্রশাসনে সংকট যেন কাটছেই না। নিত্যই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ইস্যু, সেইসঙ্গে নতুন নতুন সংকট; যা শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি পুরো সরকার ব্যবস্থাপনাকে স্থবির করতে বসেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে সৃষ্ট প্রশাসনিক জটিলতা নতুন বছরেও বিদ্যমান। প্রশাসনিক এসব জটিলতা কাটাতে পদোন্নতি, পদায়ন, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অব্যাহতি, ইনক্রিমেন্ট, মহার্ঘ ভাতার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সুরাহা করা যাচ্ছে না। এখন আবার উপসচিব পদে পদোন্নতি নিয়ে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে— যা ছড়িয়ে পড়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত। অথচ নাগরিকসেবা সহজ করা, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের গতি বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে তেমন নজর দেওয়া হয়নি; যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সচিবালয়সহ বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রশাসনের সূত্র বলছে, প্রশাসনে ক্যাডার-বৈষম্য নিরসনে বিসিএস ক্যাডারগুলোর মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। পদোন্নতি নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। ক্যাডার-বৈষম্য কমাতে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমানোর সুপারিশ করা হবে— এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। তারা দল বেঁধে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান নিয়ে তাদের দাবিগুলো সচিবের কাছে তুলে ধরেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে সরব ওই কর্মকর্তারা। অপরদিকে প্রশাসন ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘আন্তঃক্যাডার-বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ তাদের দাবি নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এসব পাল্টাপাল্টি আন্দোলনের কর্মসূচি এখন মাঠ প্রশাসনকেও অস্থির করে তুলছে।
অভিযোগ রয়েছে, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সাজানো ‘দলীয় প্রশাসনের’ শীর্ষ পর্যায়ে বড় পরিবর্তন, পদোন্নতির হিড়িক, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নিরবচ্ছিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলন, অনভিজ্ঞতায় চরম বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে জনপ্রশাসন প্রশাসন। সবশেষ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাব ঘিরে অবস্থা আরও উত্তাল হয়ে ওঠে। এতে করে সর্বত্র কাজে-কর্মে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে যতটুকু আশা জেগেছিল, তা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশের কারণে ভেস্তে গেছে। গত ১৫ বছরের কথিত বঞ্চিতদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন সামলাতেই নাজেহাল বর্তমান সরকার। গণঅভ্যুত্থানের পর সুযোগ বুঝে অনেকেই ‘অযৌক্তিক দাবি-দাওয়াও’ তুলেছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ডিসি নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন কর্মকর্তারা। এমনকি হাতাহাতিতেও জড়িয়েছেন তারা।
উল্লেখ্য, গত ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনে সাবেক অর্থসচিব ও বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী জাকির আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত দাবি করে ১ হাজার ৫৪০ জন এ কমিটির কাছে আবেদন করেন। এর মধ্যে ৭৬৪ জনকে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেছে কমিটি। তাদের মধ্যে সচিব পদে ১১৯ জন, গ্রেড-১ (সচিব মর্যাদা) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্মসচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রদান করা যেতে পারে বলে কমিটির সুপারিশে উল্লেখ করে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়া চলমান থাকার সময় এই বঞ্চিত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সচিবকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, তাদের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে।
এতসব সংকট কাটাতে এবং প্রশাসনে গতি আনতে এরইমধ্যে কয়েকধাপে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে চার মাসে ২৩ জন কর্মকর্তাকে সচিব করা হয়েছে। ১৭ জন কর্মকর্তা গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ১৩৫ জন, যুগ্ম-সচিব পদে ২২৮ জন এবং ১৩৪ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ১৪টি মন্ত্রণালয়ে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিতে।
আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে এসব পদোন্নতি ও পদায়ন করতে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতিও হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, অনিয়মে অভিযুক্ত কর্মকর্তারাও এই সুযোগে পদোন্নতি পেয়েছেন। বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সচিব কিংবা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে, যা সমালোচনার সৃষ্টি করছে। এজন্য ভুলগুলো শুধরে বারবার সিদ্ধান্ত বদলাতে দেখা যাচ্ছে। নীতি-নির্ধারণী পদের কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতা সংকটকে আরও গভীর করেছে। কারণ যাদের চুক্তিতে প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তারা অনেক দিন ধরে চাকরির বাইরে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে হচ্ছে। অপরদিকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ায় পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। খাদ্য সচিব, নৌ-সচিবসহ বেশ অনেকগুলো পদে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার পরপরই সেই নিয়োগ আবার বাতিল করতে হয়েছে।
পদোন্নতির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তারা যেমন পদোন্নতি পেয়েছেন, আবার দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তারাও পদোন্নতি পেয়েছেন। ঢালাও পদোন্নতিতে অনেক অদক্ষ কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়ে গেছেন। এ নিয়ে প্রশাসনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নানা সংকটের মধ্যদিয়ে প্রশাসন এগিয়ে গেলেও এর মধ্যে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগও এসেছে। চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি মোতাবেক সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। সর্বোচ্চ বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩২ বছর করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে সরকার। গত ১৮ নভেম্বর ‘সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাগুলোতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ অধ্যাদেশ, ২০২৪’ জারি করা হয়। তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। এসবের মধ্যেও নতুন করে সৃষ্ট প্রশাসন ক্যাডার ও বাকি ২৫ ক্যাডারের মধ্যে দ্বন্দ্ব সরকারকে নতুন সংকটে ফেলেছে।
জানা গেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের একটি সুপারিশকে কেন্দ্র করে প্রশাসনে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের উপসচিব পদে প্রশাসন থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন নামের একটি ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ এবং অন্য ২৫টি ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন কয়েকশ কর্মকর্তা। আবার অন্য ২৫টি ক্যাডারের জোট আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদও কমিশনের সুপারিশে ক্ষোভ জানিয়েছে। তারাও আন্দোলনে নামছে। কেন্দ্রীয়ভাবে বিবৃতি, এরপর কলমবিরতি, মানববন্ধন ও সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ফলে জনপ্রশাসনে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতসব ঝামেলা মাথায় নিয়ে নতুন বছরে (২০২৫ সাল) প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতার আলোকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ ফেলতে হবে সরকারকে। যাতে নতুন করে আর কোনও বিতর্কের সৃষ্টি হতে না পারে। এখন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনেই সময় কাটছে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়া তো দূরের কথা। রুটিন কাজও ঠিকভাবে চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। বিঘ্নিত হচ্ছে নাগরিকসেবা প্রদান প্রক্রিয়া। শিগগিরই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করা না গেলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে মাঠের বাস্তবতা, অর্জিত জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি দেশের জনগণের প্রতিনিধি রাজনীতিবিদদের কাছে জায়গা করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যারা দেশের এই ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, তারা হলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। গত ২০১৮ সালে অর্থনৈতিক (ইকোনমিক) ক্যাডার বিলুপ্ত করে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত করার ফলে প্রশাসন ক্যাডারে কয়েক বছর ধরে অসন্তোষ চলে আসছিল। এর মধ্যে উপসচিব পদে পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন ও প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশের বদলে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের সুপারিশের ঘোষণার পরপরই তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে প্রশাসন ক্যাডারের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং সারা দেশের ৬৪ জেলার ডিসিরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশাল ও রংপুর বিভাগের একাধিক জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, প্রশাসন হচ্ছে যেকোনও সরকারের হৃদপিণ্ড। এখানে জটিলতা সৃষ্টি হলে সব কিছুই অকেজো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই যেকোনও মূল্যে প্রশাসনের জটিলতা প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে তাদের সুপারিশ আরও দক্ষতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত করা উচিত।
তারা জানিয়েছেন, সরকারের যে কোনও সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেন প্রশাসন ক্যাডারের অফিসাররা। বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত। ক্যাডার-বৈষম্য দূর করার নামে পুরো সরকার যাতে অকেজো হয়ে না যায়, সেদিকেও নজর রাখার অনুরোধ করেন তারা।
জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘পুরো প্রশাসনকে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। প্রশাসনের যেকোনও সংকট এড়াতে পরিকল্পনা মাফিক এগোতে হবে সরকারকে। যেকোনও সরকারের সাফল্যের মাপকাঠি হচ্ছে নাগরিকসেবার মান বাড়ানো। বর্তমান সরকার নিশ্চয়ই সেদিকে নজর দিচ্ছে।
সূত্র বাংলা ট্রিবিউন