একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়া কাদের মোল্লাকে নিজেদের প্রতিবেদনে ‘শহীদ’ বলে উল্লেখ করে তোপের মুখে পড়েছে জামায়াত-শিবির আর তৎকালীন ছাত্রসংঘের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের পূর্ব মুহূর্তে এমন বিশেষণে ছাপা হওয়া সংবাদে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার কথা। হয়েছেও তাই।
দৈনিক সংগ্রামের এমন ধৃষ্টতার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেল থেকে পত্রিকাটির কার্যালয়ের সামনে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’-এর অবস্থান নেয় এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসময় তারা পত্রিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানায় এবং সম্পাদককে গ্রেপ্তারসহ পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধের দাবি জানায়। একপর্যায়ে কার্যালয়ের ফটকে তালা ঝুলিয়ে সামনে অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধরা। এমনকি এসময় সংগ্রাম কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।
এ অবস্থায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে সংগ্রামের কার্যালয় থেকে সম্পাদক আবুল আসাদকে হেফাজতে নেয় হাতিরঝিল থানা পুলিশ। এরপর শনিবার বিকেলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন মহানগর হাকিম মো. মইনুল ইসলাম।
এর আগে দুপুরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরে দুই পক্ষের শুনানি শেষে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন মহানগর হাকিম মো.মইনুল ইসলাম।
ফাঁসির দণ্ড পাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের ‘শহীদ’ বলার ধৃষ্টতা দেখানোর অপরাধে জামায়াতের মুখপত্রের সম্পাদককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা অবশ্যই ইতিবাচক। এই আইনি পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে যে কায়দায় সংগ্রাম অফিসে ভাঙচুর করা হয়েছে বলে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, সেই বিষয় নিয়েও শঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে।
স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের মুখপত্র বলেই নয়, এ ঘটনার পর এখন থেকে কোনো সংবাদ পছন্দ না হলে যেকোনো অজুহাত তুলে সংবাদমাধ্যমের উপর আঘাত করায় উৎসাহী হবে বলে আমাদের শঙ্কা। আমরা মনে করি, সংগ্রাম কর্তৃপক্ষের এই ধৃষ্টতার জবাব শুরু থেকেই আইনি প্রক্রিয়ায় দেয়া যেত। এই ভাঙচুর আর আঘাতের ফলে আন্তর্জাতিকভাবেও সরকার প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে আমরা মনে করি।
গণমাধ্যম দেশের চতুর্থ স্তম্ভ। এটা বহুকাল আগে থেকেই স্বীকৃত। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষেই আমাদের অবস্থান। তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চয়ই একটি দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত কিংবা অস্বীকার করার নাম নয়। বিশ্বের কোনো দেশেই সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে অস্বীকার করতে পারে না। সেদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারে না। এর নাম সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও নয়। তবে এমনটা যদি কেউ করেও থাকে সেজন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে পুরো সংবাদমাধ্যমের জন্যই বিষয়টি শঙ্কার বলে আমরা মনে করি। এছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহসহ এত আইন থাকতে তাকে কেন বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার বা রিমান্ড দেখাতে হবে? এ বিষয়টিও আমাদের বোধগম্য নয়।
২০১৪ সাল থেকে বছরের পর বছর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক, বার্তা প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি সংগ্রাম অফিসে ভাঙচুরের সাথে জড়িতদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। এর মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রমাণ করতে হবে তারা আইনের শাসনে বিশ্বাসী। সংবাদমাধ্যমের কোনো প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হলে কেউ যাতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কিংবা আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। এজন্য শত্রুপক্ষ হলেও কোনোভাবেই যেন সহিংসতার পথ কেউ বেছে নিতে না পারে সেই বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই মূলধারার অন্যান্য গণমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।
একই সাথে সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যাতে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো গর্হিত করতে না পারে এজন্য প্রেস কাউন্সিলসহ সংশ্লিষ্টদের যথাযথ ভূমিকা পালনের জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।