করোনাভাইরাস দিন দিন এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরি করছে যে, ক্ষুধার্ত অসহায় ও কর্মহীন মানুষরা ত্রাণবাহী ট্রাক থামিয়ে সেখানে থাকা ত্রাণ লুট করছেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমন দুর্যোগে এসব মানুষ কতোটা অমানবিক অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন তা এই একটি ঘটনায়ই বুঝা যায়। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, ক্ষুধার্ত মানুষরা এভাবে ত্রাণ লুট করলেন কেন? উত্তর একটাই, প্রধানমন্ত্রী দেশের কর্মহীন মানুষদের জন্য উপহার হিসেবে খাদ্যসামগ্রী বরাদ্দ করলেও তা যথাযথভাবে বণ্টন না করে চুরি করছেন কথিত জনপ্রতিনিধিরা।
করোনাভাইরাস সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এমন একাধিক ঘটনা দেখা গেছে। এর শুরুটা হয়েছিল ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে। সেখান থেকেই চালচুরির বিষয়টি ব্যাপক আকারে সবার সামনে আসে। বোরহানউদ্দিনের মানিকা ইউনিয়ন পরিষদের চালচোর চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন হায়দার এবং তার ছেলে নাবিল হায়দার এ নিয়ে সংবাদ করায় স্থানীয় এক সাংবাদিককে মারধর করলে মূলধারার মিডিয়ায় বিষয়টি প্রথমে ব্যাপক আকারে আসতে থাকে। জেলেদের চাল চুরির বিষয়ে ওই সাংবাদিক সংবাদ করেছিলেন। এজন্য তাকে সংবাদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য ডেকে নিয়ে মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে হত্যাচেষ্টাসহ বেধড়ক মারধর করেন চালচোর চেয়ারম্যান ও তার ছেলে।
এরপর দেশের আরও অনেক এলাকায় চাল চুরির খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে জামালপুর সদরের নরুন্দি বাজারে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতার গুদামে অভিযান চালিয়ে ৩২৬ বস্তা চাল জব্দ করেছে উপজেলা প্রশাসন। এছাড়া জেলার বকশীগঞ্জে ২০০ বস্তা (২৫ কেজি) সরকারি চালসহ নূর কালাম (৪৫) নামে এক চাল ব্যবসায়ীকে আটক করেছে পুলিশ। র্যাব-১২ বগুড়া স্পেশাল কোম্পানির সদস্যরা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১৬৮ বস্তা চালসহ নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছেন। বাড়িতে ও তার টিভি-ফ্রিজের শোরুমে ১৬৮ বস্তা চাল পাওয়া যায়। বগুড়ার শিবগঞ্জে ১০২ বস্তা চাল উদ্ধার করে মোস্তাফিজুর রহমান (৩৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর থেকে শনিবার অবৈধভাবে মজুদ রাখা ৭৩৮ বস্তা (২৫ টন) সরকারি চালসহ গোপীনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মো. আল ইসরাইল ওরফে জুবেলকে হাতেনাতে আটক করেছে র্যাব। বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউপির ভাটাউচি গ্রামের শুক্কুর আলীর বাড়ি থেকে শুক্রবার রাতে ৮ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। নাটোরের সিংড়ায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল চুরি করায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২ আওয়ামী লীগ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি ভোলার লালমোহনে এক ইউপি সদস্যের ঘরের মাটির নিচ থেকে বহু বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এসব তথ্য গত কয়েকদিন গণমাধ্যমে আসা চাল চুরির বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার কিছু খণ্ডচিত্র। প্রকৃত চোরের সংখ্যা আরও হাজারগুণ বেশি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
এসব তো গেল চালচোর ধরার কিছু খবর। এখন প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ এত বছর ক্ষমতায় থাকার পরও তাদের দলীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কেন এমন দুর্যোগেও ত্রাণের চাল চুরি করতে হয়। এর জবাব তিন ধরনের হতে পারে। প্রথমত: এই ঠুনকো প্রতিনিধিরা এতদিন ধরে যা পেয়েছেন তা হয়তো তাদের চাহিদা মেটাতে পারেনি। তাদের চেয়েও বড় চোর দেখেছেন উপরস্থ জনপ্রতিনিধিদের। এজন্য এখনও সুযোগ পেয়ে চুরি করছেন। দ্বিতীয়ত: চুরি করতে করতে তাদের লোভ বেড়ে গেছে। এটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এখন এই দুর্যোগেও তারা ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী’র পরিচয় দিচ্ছেন। তৃতীয়ত: তারা হয়তো ভেবেছেন এতদিন চুরি করে পার পেয়ে গেছি, এখনও পাবো। এতদিনই যেহেতু চুরির বিচার হয়নি, এখন এই দুর্যোগে আর বিচার হওয়ার সময় বা সুযোগ কই?
প্রধানমন্ত্রী এবার কিন্তু তাদেরকে আর সেই সুযোগ দেননি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের সাথে ভিডিও কনফারেন্স শুরু করার প্রথম দিকেই এ বিষয়ে জিরো টলারেন্সের কথা বলে দিয়েছেন। অসহায় কর্মহীন মানুষের ত্রাণ চুরি করলে তিনি যে ছাড় দেবেন না, সেটাও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু সংসদ সদস্যদের অনেকেই সেটা কানে নেননি। তারা যদি স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর বার্তা পৌঁছে দিতেন, তাহলে তাদের এমন চুরির সাহস হতো না।
এরমধ্যে ভোলার লালমোহনের চালচোরের খনির কথাই ধরা যাক। সেখানে স্থানীয় এমপি বা প্রশাসনের কারও নজরদারি বা নির্দেশনায় কিন্তু মাটির নিচ থেকে চালের বস্তা উদ্ধার হয়নি। পুলিশের জাতীয় হেল্পলাইন ৯৯৯ এ কল পেয়ে থানা পুলিশ এই অ্যাকশন নিতে বাধ্য হয়েছে। এই ঘটনা যখন ঘটছে, সেই মুহূর্তে স্থানীয় সংসদ সদস্য কিন্তু এলাকায় ছিলেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকার বিষয় না হলেও অন্য এক ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ক্যাসিনো কাণ্ডসহ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিপাকে থাকা ওই সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কথা বলতেই পারেন। এছাড়া যে বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেটাও যৌক্তিক। তাই বলে তিনি এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর বার্তা পৌঁছে দেবেন না?
এখানে এই সংসদ সদস্যের বিষয়টা ঘটনাক্রমে উদাহরণ হিসেবে আলোচনায় আনা হয়েছে। শুধু তিনি নন, বেশিরভাগ এলাকার সংসদ সদস্যরাই এখনও প্রধানমন্ত্রীর কঠোর বার্তা নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেননি। এ কারণেই এমনটা হচ্ছে। বদনামও হচ্ছে সরকারের। ইতিহাসের পাতায় এসব চুরির কথা নিশ্চয়ই লেখা থাকবে। তখন এই সংসদ সদস্যদের অনেকেই চিনবে না। তখনকার প্রজন্ম চিনবে শুধু প্রধানমন্ত্রীকে, আওয়ামী লীগ সরকারকে। তাই আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভালোবাসলে, জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা থাকলে এমন দুর্দিনে ত্রাণ চুরি বন্ধ করে অসহায় ও কর্মহীন মানুষদের পাঁশে দাঁড়ান। তাহলেই দিন শেষে সুনাম হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের। প্রধানমন্ত্রী একার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব নয়, সামষ্টিকভাবে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিসহ সবাই যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসলে তার সব ভালো সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। তাহলে আর এমন দুর্দিনে না খেয়ে থাকা মানুষদের ত্রাণ লুটের মর্মান্তিক খবর আমাদের শুনতে হবে না।
লেখক: আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রিয়দেশ নিউজের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)