প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে বৃহস্পতিবার ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় দুই প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসেন। এক ঘণ্টা ১৫ মিনিটের বৈঠকে তাঁরা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে ৩৯ দফা যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষ থেকে আজ এই যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, উভয়পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে মতবিনিময় করেন।
উভয় প্রধানমন্ত্রীই ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও অন্যান্য অভিন্নতার বন্ধনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গড়া এবং সার্বভৌমত্ব, সাম্য, আস্থা ও সমঝোতার একটি সর্বাত্মক অংশীদারিত্বের প্রতিফলন, যা কৌশলগত অংশীদারিত্বকে ছাড়িয়ে যায়। তারা একাত্তরের মহান আত্মত্যাগের জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারা দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের জনগণের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণতন্ত্র ও সাম্যের লালিত মূল্যবোধকে সমুন্নত এবং সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
দুই নেতা ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। উভয় পক্ষই ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত যৌথ পরামর্শক কমিশনের ষষ্ঠ বৈঠকের সফল আয়োজনের কথা স্মরণ করেন।
উভয় পক্ষ নিজ নিজ দেশে চলমান কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করেছেন এবং চলমান সংকটেও দু’দেশের মধ্যে যেভাবে টেকসই সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আশ্বাস দেন যে, ভ্যাকসিন ভারতে তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কাছে সরবরাহ করা হবে। উভয় নেতা এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের মধ্যে চলমান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন।
ভারত ভ্যাকসিন উৎপাদনে চিকিৎসা ও অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রেও সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। চিকিৎসা পেশাজীবীদের জন্য বাংলা ভাষায় আয়োজিত ভারতের সক্ষমতা বাড়ানো কোর্সের প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনে ভারতের আন্তরিকতার প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ভারত সরকার প্রদত্ত একটি স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গান্ধীজির দেড়শতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মহাত্মা গান্ধীর সম্মানে ডাকটিকিট উন্মোচন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
এ উপলক্ষে বিংশ শতাব্দীর দুই মহান নেতা, মহাত্মা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধুর স্মরণে তৈরি করা ডিজিটাল প্রদর্শনীর একটি প্রাথমিক ভিডিও প্রদর্শিত হয়। উভয় নেতা আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন শহর, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘে প্রদর্শিতব্য এই প্রদর্শনীটি বিশেষত তরুণদের মধ্যে ন্যায় বিচার, সমতা ও অহিংসার মূল্যবোধ জাগ্রত করবে।
উভয় পক্ষই উল্লেখ করেন যে, ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিকের শুটিং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হবে।
২০২১ সাল ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ঐতিহাসিক হয়ে উঠবে। কারণ, দুই দেশ মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশতম বার্ষিকী এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ককে স্মরণ করবে, এই ভাবনায় তারা এই দুই যুগান্তকারী অনুষ্ঠান স্মরণে যৌথভাবে ভারত, বাংলাদেশ ও তৃতীয় দেশগুলোতে বেশ কযয়েকটি কার্যক্রমের আয়োজন করার বিষয়ে সম্মত হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মুজিবনগর থেকে নদিয়া পর্যন্ত সড়কটির মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঐতিহাসিক তাৎপর্য স্মরণ করে সড়কটিকে ‘স্বাধীনতা সড়ক’ হিসেবে নামকরণে বাংলাদেশের প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য ভারতীয় পক্ষকে অনুরোধ করেন।
উভয় পক্ষ সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যুব ও ক্রীড়া এবং গণমাধ্যম প্রচারের জন্য দুই দেশের গ্রুপগুলোর মধ্যে নিয়মিত বিনিময় অব্যাহত রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে ইছামতি, কালিন্দী, রায়মঙ্গল ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর তীরে মেইন পিলার এক থেকে স্থল সীমান্তের শেষ সীমা পর্যন্ত নতুন স্ট্রিপ মানচিত্রের সেট প্রস্তুত করতে এবং স্থল সীমানা চূড়ান্তকরণে উভয় পক্ষই যৌথ সীমান্ত সম্মেলনের প্রথম বৈঠক করতে সম্মত হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী আন্তর্জাতিক সীমানাকে একটি নির্দিষ্ট সীমানায় রূপান্তর করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে।
বাংলাদেশ তার রাজশাহী জেলার নিকটবর্তী পদ্মানদীর তীরে নদীপথে ১.৩ কিলোমিটার ইনোসেন্ট প্যাসেজের অনুরোধটি পুনর্ব্যক্ত করেছে। ভারতীয় পক্ষ অনুরোধটি বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছে।
উভয় নেতা ত্রিপুরা (ভারত)-বাংলাদেশ সেক্টরের শুরু থেকে দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন সমাপ্তকরণে সম্মত হন। উভয় নেতা এ ব্যাপারেও একমত হয়েছেন যে সীমান্তে নাগরিকের প্রাণহানির বিষয়টি উদ্বেগের এবং এ ধরনের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সীমান্ত বাহিনীকে নির্দেশনা দেন। নেতারা চলমান সমন্বিত সীমান্ত পরিচালনা পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর জোর দিয়েছেন। উভয় পক্ষই অস্ত্র, মাদক ও জাল মুদ্রা চোরাচালান এবং মহিলা ও শিশু পাচার রোধে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ ও ভারত ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির সম্মুখহীন হয় উল্লেখ করে দুই নেতা উভয়পক্ষের কর্মকর্তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তিটি সম্পাদনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
সন্ত্রাসবাদকে বৈশ্বিক শান্তি ও সুরক্ষার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে উভয় পক্ষ সন্ত্রাসবাদের সব কার্যক্রম নির্মূল করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছে।
উভয়পক্ষই দু’দেশের মধ্যে জনগণের চলাচল সহজীকরণের উপর জোর দিয়েছে। আখাউড়া (ত্রিপুরা) এবং ঘোজাডাঙ্গা (পশ্চিমবঙ্গ) চেকপয়েন্ট থেকে শুরু করে বৈধ কাগজপত্রধারী বাংলাদেশিদের জন্য ভারতে প্রবেশ/বহির্গমন নিষেধাজ্ঞা অপসারণের প্রতিশ্রুতি শিগগিরই বাস্তবায়নের জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সাল থেকে সাফটার আওতায় ভারতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রশংসা করেছেন। উভয় প্রধানমন্ত্রী বন্দরের বিধিনিষেধ, প্রক্রিয়াগত বাধা ও কোয়ারেন্টিন বিধিনিষেধসহ অশুল্ক বাধা সমাধান ও বাণিজ্য সুবিধার উপর জোর দিয়েছেন, যাতে উভয় দেশ সাফটা নমনীয়তার পুরোপুরি সুবিধা নিতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল যে, যেহেতু ভারত থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য রপ্তানি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে প্রভাবিত করে, তাই ভারত সরকারের রপ্তানি নীতিতে যে কোনো সংশোধনী যেন আগাম জানানো হয়। ভারতীয় পক্ষ এই অনুরোধ বিবেচনায় নিয়েছিল।
উভয় নেতা কোভিড-১৯ মহামারিতে বিদ্যমান রেলরুটের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজতর করা, সাইড-ডোর কনটেইনার এবং পার্সেল ট্রেন ব্যবহার করে সরবরাহ শৃঙ্খল অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য বাণিজ্য ও রেল কর্মকর্তাদের প্রশংসা করেন।
দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের অপরিসীম সম্ভাবনা চিহ্নিত করে উভয় প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তাদের দ্বিপক্ষীয় ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (সিইপিএ)সম্ভাবনা নিয়ে চলমান যৌথ গবেষণাটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বছরের শুরুর দিকে ভারত-বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ফোরামের প্রথম বৈঠককে স্বাগত জানিয়ে নেতারা টেক্সটাইল সেক্টরে বর্ধিত সংযোগ ও সহযোগিতার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং ভারত সরকারের বস্ত্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি বিষয়ে চলমান আলোচনা সমাপ্ত করার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাটজাত পণ্য রপ্তানির জন্য চাপানো অ্যান্টি-ডাম্পিং/অ্যান্টি- সারকামভেনশন শুল্কের পরামর্শকে স্বাগত জানিয়েছে এবং এডিডির সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
উভয় প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের মধ্যে ১৯৬৫ সাল পূর্ববর্তী রেলপথ পুনরুদ্ধারে অব্যাহত অগ্রগতিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা যৌথভাবে হলদিবাড়ি (ভারত) এবং চিলাহাটির (বাংলাদেশ) মধ্যে পুনঃস্থাপিত নতুন রেলপথ উদ্বোধন করেন এবং উল্লেখ করেছেন যে, এই রেলপথটি দুই দেশের বাণিজ্য ও জনগণের সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে। কোভিড পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনটি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
দুই নেতা চলমান দ্বিপাক্ষিক সংযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেন এবং পিআইডব্লিওটিটির অধীনে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলায় ভারতীয় পণ্যের পরীক্ষামূলক পরিবহন, সোনামুড়া-দাউদকান্দি প্রোটোকল রুট চালু এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও বাণিজ্য (পিআইডব্লিওটিটি) প্রোটোকলে দ্বিতীয় সংযোজন স্বাক্ষরসহ সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানান। দুই নেতা শিগগিরই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য পরিবহন চালু করতে সম্মত হন।
দু’দেশের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এবং যোগাযোগ সহজ করার জন্য, নেতারা বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের জন্য সমঝোতা স্মারক সক্রিয়করণের মাধ্যমে বিবিআইএন মোটর যান চুক্তিটি দ্রুত কার্যকর করার বিষয়ে একমত হন। এতে ভুটান পরবর্তীতে যোগদানের বিধান থাকবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চলমান ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্পের প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এই প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে ভারতের সমর্থন কামনা করেন। একইভাবে ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ (হিলি) থেকে মেঘালয় (মহেন্দ্রগঞ্জ) পর্যন্ত যোগাযোগের অনুমতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছিল।
ভারত আগরতলা-আখাউড়া থেকে শুরু করে ভারত এবং বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে ন্যূনতম নেতিবাচক তালিকাযুক্ত (মিনিমাল নেগেটিভ লিস্ট) কমপক্ষে একটি স্থলবন্দর থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে তার অনুরোধ পুনর্ব্যক্ত করেছিল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, চটগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহণের জন্য বাংলাদেশি ট্রাকগুলো ফেনী সেতু (নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর) ব্যবহার করবে।
দু’দেশের মধ্যকার দৃশ্যমান উন্নয়ন অংশীদারিত্ব স্বীকার করে, উভয়পক্ষই নিয়মিতভাবে ঋণ প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে বাংলাদেশ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনারের নেতৃত্বে সদ্য গঠিত উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং কমিটির সক্রিয় পরিচালনার উপর জোর দিয়েছিলেন।
কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন দু’দেশের যাত্রীদের জরুরি প্রয়োজনে উভয়পক্ষের মধ্যে অস্থায়ী এয়ার বাবল শুরুর বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ পক্ষও ভারতীয় পক্ষকে শিগগিরই স্থলবন্দর দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করার অনুরোধ জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে উভয় সরকারের সম্মতি অনুসারে তিস্তার পানিবণ্টনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষর করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাতে ভারতের সরকারের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি এবং অব্যাহত প্রচেষ্টার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
দুই নেতা মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতি, ধরলা ও দুধকুমার- ছয়টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির কাঠামোটির দ্রুত সমাপ্তির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ পক্ষ কুশিয়ারা নদীর পানিসেচের জন্য রহিমপুর খালের অবশিষ্ট অংশের খনন কাজ সম্পন্ন করার জন্য ভারতীয় পক্ষকে সংশ্লিষ্ট সীমান্ত কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করেছে। কুশিয়ারা নদী থেকে দুই দেশের পানি প্রত্যাহার পর্যবেক্ষণের জন্য উভয় দেশের মধ্যে প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারকটি সম্পর্কে দ্রুত সমঝোতার জন্য ভারতীয় পক্ষকেও অনুরোধ করা হয়েছিল। দুই নেতা যৌথ নদী কমিশনের ইতিবাচক অবদানের কথা স্মরণ করেন এবং সচিব পর্যায়ের জেআরসি পরবর্তী বৈঠকের অপেক্ষা ব্যক্ত করেন।
বেসরকারি খাতসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে শক্তিশালী সহযোগিতা নিয়ে উভয়পক্ষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন, মৈত্রী সুপার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি অন্যান্য প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল। উভয়পক্ষই হাইড্রোকার্বন সেক্টরে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা কাঠামো স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছে যা বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, যৌথ গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং হাইড্রোকার্বন সংযোগের প্রচারকে আরও সহজলভ্য করে জ্বালানি সংযোগকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। জৈব জ্বালানিসহ জ্বালানি দক্ষতা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সহযোগিতা বৃদ্ধিতেও সম্মত হয়েছিল। পরিবেশবান্ধব, পরিষ্কার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উভয় দেশের প্রতিশ্রুতি অনুসারে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছিল। উভয়পক্ষ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করতেও সম্মত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১.১ মিলিয়ন মানুষকে আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেছেন। উভয় প্রধানমন্ত্রী তাদের নিরাপদ, দ্রুত এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের গুরুত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ভারতকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ভারতের সহায়তার প্রতি বাংলাদেশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচনে ভারতকে সমর্থন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উভয় দেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দ্রুত সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন ও অভিবাসীদের অধিকার সুরক্ষায় একসাথে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। উভয় প্রধানমন্ত্রীই ২০৩০ সালের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত এসডিজিগুলি বাস্তবায়নের উপায় নিশ্চিত করার জন্য গ্লোবাল পার্টনারশিপের আওতায় উন্নত দেশগুলির প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
উভয় নেতা কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পরে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সার্ক এবং বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের প্রতি আলোকপাত করেন। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পর ২০২০ সালের মার্চে সার্ক নেতাদের ভিডিও কনফারেন্স আহ্বানের জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বৈশ্বিক মহামারির প্রভাব মোকাবিলায় সার্ক জরুরি প্রতিক্রিয়া তহবিল তৈরির প্রস্তাব দেওয়ায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সার্ক মেডিক্যাল ও জনস্বাস্থ্য গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রস্তাবটিও পুনর্ব্যক্ত করেন এবং এ ব্যাপারে সহায়তা চান। বাংলাদেশ ২০২১ সালে আইওআরএ’র সভাপতিত্ব গ্রহণ করবে এবং বৃহত্তর সামুদ্রিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় কাজ করার জন্য ভারতের সহায়তা কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী বর্তমান মেয়াদে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামে বাংলাদেশের সভাপতিত্বের প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাজের প্রশংসা করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি অবকাঠামো উন্নয়নসহ একাধিক খাতে ব্যাংকের কাজকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং এই উদ্যোগের অংশ হওয়ার জন্য বাংলাদেশের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এই উপলক্ষে, ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা নিম্নলিখিত দ্বিপাক্ষিক দলিলগুলি স্বাক্ষর ও বিনিময় করেছেন: হাইড্রোকার্বন সেক্টরে সহযোগিতা সম্পর্কিত সমঝোতা কাঠামো, আন্তঃসীমান্ত হাতি সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রটোকল, উচ্চ প্রভাব কমিউনিটি উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের কাঠামোগত চুক্তি, বরিশাল সিটি করপোরেশনে আবর্জনা/কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশন স্থলের সরঞ্জাম সরবরাহ ও উন্নয়নের বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি, ভারত-বাংলাদেশ সিইও ফোরামের রেফারেন্সের শর্তাদি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা এবং ন্যাশনাল মিউজিয়াম, নয়াদিল্লির মধ্যে সমঝোতা চুক্তি এবং কৃষিক্ষেত্রে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক।
নিম্নলিখিত দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারিত্ব প্রকল্পগুলিও উদ্বোধন করা হয়েছে রাজশাহী শহরে সৌন্দর্য ও নগর উন্নয়ন প্রকল্প ও খুলনায় খালিশপুর কলেজিয়েট গার্লস স্কুল নির্মাণ।
উভয় প্রধানমন্ত্রী নতুন স্বাভাবিক ব্যবস্থায় (নিউ নর্মাল) এই সম্মেলন আয়োজন করার জন্য একে অপরকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী এবং বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানান।