প্রয়াত: যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ১০০ বছর বয়সে এসে মারা গেছেন। তার ফাউন্ডেশন – কার্টার সেন্টার তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। রোববার তিনি জর্জিয়ার প্লেইনসে নিজ বাড়িতেই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জো বাইডেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ দেশটির রাজনীতিবিদরা। উল্লেখ্য, দেশটির ইতিহাসে জিমিই প্রথম শতবর্ষী প্রেসিডেন্ট।

ডেমোক্র্যাট দল থেকে নির্বাচিত জিমি কার্টার ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশটির ৩৯ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তিনি।তার ছেলে চিপ কার্টার জানিয়েছেন, ”আমার বাবা শুধু আমার কাছেই নন, যারা শান্তি, মানবাধিকার ও স্বার্থহীন ভালোবাসায় বিশ্বাস করেন, তাদের সকলের কাছেই হিরো।”

জর্জিয়ার প্লেইনসে নিজের বাড়িতে তিনি মারা যান। কার্টারই হলেন অ্যামেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রেসিডেন্ট। গত অক্টোবরে তিনি একশ বছরে পড়েন।কার্টার সেন্টার জানিয়েছে, প্লেইনসেই তার দেহ সমাধিস্থ করা হবে। তবে তার আগে অ্যাটলান্টা ও ওয়াশিংটনে দুইটি ইভেন্ট হবে, যেখানে মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দেহ সমাহিত হবে।

কার্টারের যাত্রা শুরু হয়েছিল জর্জিয়ার একটি ছোট্ট শহর প্লেইন্সে। তিনি সেখানে ১ অক্টোবর, ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

কিশোর বয়স থেকেই সাউদার্ন ব্যাপ্টিস্ট সানডে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন জিমি কার্টার। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনেও শক্তিশালী নৈতিকতার চেতনা নিয়ে আসেন তিনি। কোনো রাখঢাক ছাড়াই নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়টি প্রকাশ করতেন জিমি কার্টার।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে একজন অফিসার হিসেবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পারমাণবিক সাবমেরিন বহরের উন্নয়নে সহায়তা করেছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে কার্টার পারিবারিক চিনাবাদাম চাষের ব্যবসা চালানোর জন্য ১৯৫৩ সালে তার নিজ শহরে ফিরে আসেন।

জিমি ১৯৬০-এর দশকে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাজ্যের ৭৬তম গভর্নর হওয়ার আগে জর্জিয়ার প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৭৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কার্টার জেরাল্ড ফোর্ডের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করার পরে রাষ্ট্রপতির পদে অভিষিক্ত হন। কার্টার ফোর্ডকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে পরাজিত হন জিমি।

হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর তিনি নিজের হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে কাজ শুরু করেন। তিনি কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন মানবিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। মানবাধিকার রক্ষা, দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশে কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রচেষ্টা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিসাধন এবং পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।জিমি কার্টার ১৯৪৬ সালে বিয়ে করেছিলেন রোসালিন স্মিথকে। তারপর ৭৭ বছর ধরে তারা একসঙ্গে থেকেছেন। গত বছর নভেম্বরে ৯৬ বছর বয়সে মারা গেছেন রোসালিন। এবার চলে গেলেন জিমি কার্টারও। রেখে গেলেন চার সন্তান, ১১জন নাতি-নাতনি এবং তাদের ১৪ জন প্রপৌত্র ও প্রপৌত্রীকে।‘দ্য লংজিভিটি প্রজেক্ট’ বইয়ের লেখক, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক ডা. হাওয়ার্ড ফ্রেডম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের শতবর্ষী জীবনের বেশ কিছু কারণ জানিয়েছেন।

গত ১ অক্টোবর শততম জন্মদিন পালন করেন সদ্য প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট, শান্তিতে নোবেলজয়ী জিমি কার্টার। নব্বইয়ের পরও ছিলেন শারীরিকভাবে কর্মক্ষম।

জিমি কার্টার ও তাঁর স্ত্রী শেষ বয়সে নিজেদের বিভিন্ন মানবিক কাজে যুক্ত রেখেছিলেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ১৪টি দেশে ৪ হাজার ৩০০টি পরিবারের বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। ১৯৮৪ সাল থেকেই তাঁরা ‘হ্যাবিট্যাট ফর হিউম্যানিটি’সহ বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন।

হোয়াট মেকস আ ম্যারেজ লাস্ট’ বইয়ের সাক্ষাৎকারে জিমি কার্টারের স্ত্রী রোজালিন কার্টার বলেন, ‘জিমি যখন “ডাউনহিল স্কি” শেখে, তখন তার বয়স ৬২। জিমি কেবল নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনেই ক্ষান্ত দেয়নি, বরং সে সেসবের অনুশীলন করত।’ নতুন কিছু শেখার আনন্দ, দক্ষতা, নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়ানো—এসব মানুষকে দীর্ঘদিন বাঁচতে সাহায্য করে।

কার্টার ও তাঁর স্ত্রী ৭৭ বছর ধরে দাম্পত্য সম্পর্কে ছিলেন। ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর রোজালিনের মৃত্যুর পর কার্টার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘রোজালিন ছিল সবকিছুতেই আমার সমান অংশীদার। জানতাম, আমার পাশে এমন একজন আছে, যে আমাকে ভালোবাসে আর যে আমার সবকিছুতেই সমর্থন করবে, পাশে থাকবে।’ রোজালিনের মৃত্যুর পর এই দম্পতির কন্যা অ্যামি কার্টার মায়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে একটা চিঠি পড়ে শোনান। চিঠিটি জিমি কার্টার তাঁর স্ত্রীকে লিখেছিলেন ৭৫ বছর আগে। সেখানে জিমি লিখেছিলেন, ‘প্রতিবার আমি যখন তোমাকে রেখে দূরে কোথাও যাই, ফিরি এসে নতুন নতুনভাবে আবিষ্কার করি, তুমি কী দুর্দান্ত, অসাধারণ একজন। তোমাকে দেখে নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি।’

৮০ বছর বয়স পর্যন্ত জিমি নিয়মিত দৌড়াতেন। তারপর হাঁটুব্যথার কারণে দৌড়ের বদলে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন আর হাঁটতেন। ২০১৩ ও ২০১৮ সালে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিমি এ কথা জানান। জিমি ও তাঁর স্ত্রী সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন। এ ছাড়া দুজন মিলে বাড়ির আঙিনায় কৃষিকাজ করতেন। জিমির খাদ্যাভ্যাস ছিল খুবই স্বাস্থ্যকর।কখনো ধূমপান করেননি।

জিমি কার্টার ছিলেন মানসিক শক্তিতে উজ্জীবিত। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ও পরে বেশ কিছু সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন। বেশ কয়েকবার স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছেন। সবকিছুর ভেতরে তিনি কেবল শান্তি খুঁজেছেন।তাঁর মানসিক শক্তি, ইতিবাচকতা, প্রাণোচ্ছলতা, সহনশীলতা তাঁকে শতবর্ষী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন।

কার্টারের প্রয়াণে তাঁর জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

পানামা খাল

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্টার তাঁর মেয়াদের প্রথম বছরে একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে পদক্ষেপ নেন। তিনি পানামা খালের ব্যবস্থাপনা পানামার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।গত শতকের শুরুর দিকে এই খাল খনন করা হয়। শুরু থেকে খালটি মার্কিন সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

১৯৭৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কার্টার ও পানামার জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর তোরিজোস পানামা খাল চুক্তি সই করেন। চুক্তির শর্ত মেনে ১৯৯৯ সালে পানামার কাছে খালটির নিয়ন্ত্রণ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে যুক্তরাষ্ট্র।চুক্তি সইয়ের সময় কার্টার বলেছিলেন, বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তির কেন্দ্রে থাকা উচিত ন্যায্যতা, বলপ্রয়োগ নয়।

এই পদক্ষেপের জন্য কার্টারকে নিজ দেশে উপহাসের শিকার হতে হয়েছিল। তবে ইতিহাস অবশ্য এই চুক্তিকে কূটনীতির একটি নিপুণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখে আসছে।কার্টারের মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পানামার বর্তমান প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো বলেছেন, সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট পানামাকে নিজ দেশের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব অর্জনে সহায়তা করেছিলেন।

রাজনীতিতে নৈতিকতা

কার্টার হোয়াইট হাউসে এসে তাঁর পূর্বসূরিদের চর্চা করা ‘অনৈতিক রাজনৈতিক’ বিষয় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি মানবাধিকারকে তাঁর প্রশাসনে গুরুত্বের কেন্দ্রে রেখেছিলেন।

১৯৭৮ সালে মার্কিন নেভাল একাডেমিতে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন কার্টার। বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো এমন একটি বিশ্ব গঠনে সহায়তা করা, যা অর্থনৈতিক মঙ্গল, সামাজিক ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মৌলিক মানবাধিকারের জন্য সর্বত্র মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি আরও দ্রুত সাড়া দেয়।’

কার্টার ১৯৭৭ সালে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি

১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে কার্টার তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে আমন্ত্রণ জানান।

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরাতে কার্টারের মধ্যস্থতায় ১৩ দিনের গোপন আলোচনার পর দুটি চুক্তি সই হয়। কার্টারকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার সময় এই চুক্তিকে (ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি) একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

ইরান জিম্মি সংকট

১৯৭৯ সালের নভেম্বরে ইরান জিম্মি সংকটের সূত্রপাত হয়। ১৯৮১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তা চলে।ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে ৫০ জনের বেশি আমেরিকানকে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল।

কার্টারের জন্য এই সংকট ছিল ‘অগ্নিপরীক্ষা’।জিম্মি সংকটের অবসানে ১৯৮০ সালের এপ্রিলে একটি ব্যর্থ সামরিক অভিযান চালানও হয়। আর এই ব্যর্থতা একই বছরের শেষ দিকে কার্টারের পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা শেষ করে দেয়।