বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও সুপিরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী মারা গেছেন। তার ছেলে সাগর লোহানী প্রিয়দেশ নিউজকে জানান সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়। এর আগে শুক্রবার (১৯ জুন) বিকাল ৫টার দিকে তাকে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কামাল লোহানীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সাগর লোহানী বলেন, ‘ভোর সাড়ে ৬টায় বাবাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সোয়া ১০টায় লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। বাবার মাল্টিপাল অরগান অফ হয়ে গিয়েছিল। প্রেসার কমে গিয়েছিল, একেবারেই বাড়েনি। কিনডি ইনঅ্যাকটিভ হয়ে গিয়েছিল।’ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরে তাকে সমাহিত করা হবে।
ফুসফুস ও কিডনির জটিলতা নিয়ে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন কামাল লোহানী। সেখান থেকেই তাকে কোভিড ডিডিকেটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শুক্রবার সাগর লোহানী বলেন, ‘বর্তমানে তিনি গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। কিছু শারীরিক জটিলতার কারণে বুধবার বাবাকে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিনই তার করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নেওয়া হয়। শুক্রবার পরীক্ষার রিপোর্টে পজিটিভ আসে। এরপর তাকে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নিয়ে আসি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে গত ৫ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরেন তার বাবা। এরপর করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে আর কোথাও চিকিৎসা করানো হয়নি। শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ১৭ মে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা নিয়ে ২ জুন বাসায়ও ফিরে যান। আবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ফের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কামাল লোহানীর কিডনিজনিত সমস্যার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।
এদিকে, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
কামাল লোহানীর পথচলা
আবু নাইম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী – বাংলাদেশে কামাল লোহানী নামেই তিনি ছিলেন পরিচিত।
তিনি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও পরে বায়ান্ন সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন ।সে সময়েই ভাষা আন্দোলনে জড়িত হবার মধ্য দিয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে।পরে কয়েক দফা জেল খেটেছেন এবং একই সাথে কারাগারে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমেদের মতো নেতাদেরও সাথেও। এক পর্যায়ে জড়িত হন বামপন্থী ধারার রাজনীতিতে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছেন নীতি ও আদর্শে অবিচল থেকে সবসময় দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি।
“১৯৬০ সালে তাকে প্রথম যখন দেখি তখন আমি স্কুলের ছাত্র। কামাল লোহানী তখন ছিলেন নৃত্যশিল্পী। আমি একটা সিনেমায় অভিনয় করেছিলাম সেখানে নাচের দল ছিলো তাতেও তাকে পেয়েছিলাম। তিনি একজন বিপ্লবী। সৈনিক হিসেবেই তাকে বিবেচনা করি। তিনি আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গনকে যেমন সমৃদ্ধ করে গেছেন তেমনি মানুষের মুক্তি ও শোষণমুক্ত সমাজের জন্য সব সংগ্রামেই তিনি একাত্ম ছিলেন”।
জীবনের শুরু থেকেই কামাল লোহানী ছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ সক্রিয় । ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রনাথ বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলো।
১৯৬২ সালে তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। এরপর পাঁচ বছরের মাথায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি, যাতে সক্রিয় ছিলেন আলতাফ মাহমুদ সহ আরও অনেকে প্রথিতযশা শিল্পী।
আবার ষাটের দশকের শেষ দিকে যোগ দেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপে এবং সক্রিয় হন আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে। ওই সময় পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে শিল্পীদের সংগঠিত করার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান।
পঁচাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর আবারো সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িত হন কামাল লোহানী। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলছেন কামাল লোহানীর মতো ব্যক্তিরা ছিলেন বলেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান হয়েছিলো।
“৬৭ সাল থেকে কামাল লোহানীকে চিনি। ৬১ সালে যখন রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী বন্ধ করার চেষ্টা হলো তখনো কামাল লোহানী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো। ৬৭-৬৮ সালে পাকিস্তান যখন রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধের পায়তারা করছিলো তখনো তার একই ভূমিকা ছিলো। ছায়ানটের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্রান্তির মতো বিপ্লবী সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধানতম ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। কামাল লোহানীকে আমরা সবসময় একজন বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করবো”।
তিনি বলছেন ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের জন্যও কামাল লোহানী তার ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন এবং এ ধরণের মানুষ ছিলো বলেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন কখনো পথ হারায়নি।
সাংবাদিকতায় কামাল লোহানী
আবার রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বাইরে কামাল লোহানীর দীর্ঘ পেশাগত জীবন ছিলো সাংবাদিকতায়। কাজ করেছেন দৈনিক মিল্লাত ও দৈনিক আজাদসহ অনেকগুলো সংবাদপত্রে। কাজের পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠনুগলোতেও।
অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মিস্টার লোহানী। সিনিয়র সাংবাদিক ও বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
“ব্যক্তিগত জীবনে সৎ একজন মানুষ। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় শতভাগ উত্তীর্ণ। সাংবাদিকতা করেছেন কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জীবনের শেষ ভাগে যখন কাজ করছিলেননা তখনো যখনি পরামর্শ চেয়েছি তখনি সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন । এমনকি নবম ওয়েজ বোর্ডের আন্দোলনে আমাদের অনশনেও যোগ দিয়েছিলেন।”
সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে একুশে পদক পান কামাল লোহানী।ছায়ানট ছাড়াও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাথে কামাল লোহানীর সংশ্লিষ্টতা ছিলো দীর্ঘকালের।ব্যক্তিজীবনে দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক কামাল লোহানীর স্ত্রী দীপ্তি লোহানী প্রয়াত হয়েছেন আগেই।
বিশ্লেষকরা বলেন,বাঙ্গালীর দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পথ ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের চার দশকে -রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম যে অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন তা সবসময়ই নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে ।