করোনায় পুলিশের মানবিক রুপান্তর

অতীতে পুলিশকে নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করলেও বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পুলিশকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে মানবিক ভূমিকায়। এমন পুলিশকেই মানুষ দেখতে চান।আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশ ছিল প্রথম প্রহরের প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং এই করোনা পরিস্থিতিতেও যেন পুলিশই সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ।এ সময়টা এত কঠিন আর অবাস্তব যে অনেক মানুষ তার স্বাভাবিক মানবিকতাবোধ হারিয়েছে।নিজের রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করছে। আর সেটা এমনই যে কোনো কোনো স্থানে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ গ্রহণ তো দূরে থাক জানাজা পড়ানোর জন্যও পরিবারের কেউ ছিল না। সেখানে পুলিশের সদস্যরা জানাজা পড়েছেন, কবর খুঁড়েছেন এবং দাফন করেছেন।

পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, পুলিশকে জনগণের প্রথম ভরসার স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। জনগণের আস্থা অর্জনের সে লক্ষ্যেই পুলিশ বাহিনী কাজ করছে। করোনার কারণে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা গরিব, অসহায় মানুষদের ঘরে গিয়ে খাবারসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। নিজেদের গাড়ি করে রোগীদের পৌঁছে দিচ্ছেন হাসপাতালে। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, নগরবাসীর নিরাপত্তায় নিরলসভাবে কাজ করছে পুলিশ। করোনার আতঙ্কে প্রায় সবাই যখন বাসা বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছে সেখানে ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা। এরই মধ্যে অনেক পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা অনেক পুলিশ সদস্য বলেছেন, করোনার ঝুঁকি মোকাবেলা করার মতো তথা স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রাখার মতো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম তারা পাচ্ছেন না। শুধু মানবিকতার স্বার্থেই সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন তারা।

সূত্রে জানা গেছে,রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী গুরুত্বপূর্ণ জেলা টাঙ্গাইলে মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাব বেশ পড়েছে। উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহসহ ২৩ জেলার প্রবেশদ্বার হওয়ায় টাঙ্গাইল করোনার ঝুঁকিতে প্রথম থেকেই। এই করোনাকালে পেশাদারিত্বের পাশাপাশি টাঙ্গাইল জেলা পুলিশের মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়ের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে পুলিশ সদস্যরা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারি কার্যক্রমগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের মায়া পেছনে ফেলে তারা জীবন বাজি রেখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যা সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

মিডিয়ার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহীনুল ইসলাম ফকির “প্রিয়দেশ”কে জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে জনগণকে সচেতন করতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ২০ হাজারেরও বেশি লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে।সেই সঙ্গে মাইকিং, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক এবং স্থানীয় ক্যাবল টিভির মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে নিয়মতি ভিডিও প্রচার চালাচ্ছেন। কয়েক হাজার বিদেশ ফেরতের বাড়ি বাড়ি গিয়ে লাল নিশান টানিয়ে তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করা হয়েছে।লকডাউন কার্যকর রাখতে জেলা-উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং প্রবেশ-বাহির পথে ৫২টি চেকপোস্ট বসিয়ে নিরলসভাবে কাজ করেছে পুলিশ সদস্যরা। কৃত্রিম সংকট ও দ্রব্যমূল্য রোধ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পুলিশ সদস্যরা অনবরত টহল মনিটর করছেন। দোকানের সামনে পুলিশের পক্ষ থেকে এঁকে দেওয়া হয়েছে গোলাকার চিহ্ন। জেলা থেকে ১১৩০ জন শ্রমিককে অন্য জেলায় পাঠানো হয় ধান কাটার জন্য। এ ছাড়া করোনা আক্রান্তদের বাড়ি লকডাউনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ৩৬৪০টি কর্মহীন ও অসহায় পরিবারকে এবং ঈদের আগে ৭০০ জন পরিবহন শ্রমিকের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়।

এদিকে ব্যক্তি উদ্যোগে সর্বপ্রথম টাঙ্গাইল সদরের ওসি মীর মোশারফ হোসেন থানায় জনসাধারণের জন্য জীবাণুনাশক ছিটানোর ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেন। কালিহাতী থানার ওসি হাসান আল মামু তৃতীয় লিঙ্গের শতাধিক সদস্যকে খাদ্যসামগ্রী প্রদান করেন। গোপালপুর থানার ওসি মুস্তাফিজুর করোনা আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি খাবার সামগ্রী নিয়ে হাজির হয়েছেন। পরে তিনিও করোনা আক্রান্ত হন। বর্তমানে সুস্থ হয়ে কাজে যোগদান করেছেন। টাঙ্গাইল ডিবি পুলিশের ওসি শ্যামল কুমার দত্ত এবং মির্জাপুর থানার ওসি সায়েদুর রহমান মির্জাপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি করোনা আক্রান্ত জাহাঙ্গীর হোসেনের মনোবল চাঙ্গা রাখতে উপহার সামগ্রী পাঠান। এসব বিষয় সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় “প্রিয়দেশ”কে বলেন, জেলা পুলিশের প্রতিটি সদস্য করোনার মধ্যে সর্বোচ্চ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন। ৬ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু করোনাকালে নয়, দেশ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় আমরা সদা সচেষ্ট আছি। করোনায় সেবার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক রাখতে আমাদের তৎপরতা আগের মতোই চলছে।

জনগণকে লকডাউন মানাতে এবং সচেতন করতে পুলিশ প্রশাসনকে আরও কঠোর হওয়ার অনুরোধ টাঙ্গাইলের বিশিষ্টজনের। পুলিশ সুপারও তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

এদিকে বৃহস্পতিবার সিলেটের গোয়াইনঘাটে করোনার উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তি মৃত্যুর পর রাস্তায় পড়েছিলেন। কিন্তু সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। এমন সময় এগিয়ে এলো ‘মানবিক পুলিশ’।

খবর পেয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিনের নির্দেশে বৃষ্টিতে ভিজে লাশ উদ্ধার করা থেকে শুরু করে জানাজা, কবর খোঁড়া, দাফন সবই করেছে গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ।

জানা গেছে, গতকাল ১৭ জুন (বুধবার) সন্ধ্যায় সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের জাহের মিয়ার ছেলে নাজিম উদ্দিন (৪৫) করোনা উপসর্গ নিয়ে ওষুধ কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হন।

নাজিম উদ্দিন বাড়ি ফেরার পথে রাধানগর-হাজীপুর রাস্তায় জাফলং চা-বাগান সংলগ্ন এলাকায় রাস্তার পাশে মারা যান। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে নাজিম মারা যাওয়ায় স্থানীয়রা তার লাশে ভয়ে হাত দেননি।

পরে বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) ভোরে রাধানগর-হাজীপুর রাস্তায় অজ্ঞাতনামা একটি লাশ পড়ে আছে খবর পায় গোয়াইনঘাট থানার পুলিশ। খবরটি চলে যায় সিলেটের এসপি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন পিপিএম এর কাছেও।

এরপর পুলিশ সুপার তাৎক্ষণিকভাবে গোয়াইনঘাট থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মো. আব্দুল আহাদকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন।

পরে গোয়াইনঘাট থানার পুলিশ জাফলং চা-বাগান সংলগ্ন এলাকা থেকে নাজিম উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করেন।

পরবর্তীতে বাদ আসর থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মো. আব্দুল আহাদের নেতৃত্বে মরহুমের জানাজার নামাজ পড়ানো হয়। এরপর পারিবারিক কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করে পুলিশ।

কবর খোঁড়ার কাজে পুলিশকে এলাকার কয়েকজন লোক সহায়তা করেন বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর ও গণমাধ্যম) মো. লুৎফর রহমান।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবারের পাশে সহযোগিতার হাত নিয়ে শুরু থেকেই দাঁড়িয়েছে গোয়াইনঘাট থানার পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি পুলিশ নিজের বেতন, বোনাস এমনকি রেশনের অংশ দিয়েও দুস্থ এবং বিপাকে পড়া মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে পুলিশ সদস্যরা পালন করছেন একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

এ বিষয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন “প্রিয়দেশ” নিউজকে বলেন, সিলেট জেলার প্রতিটি থানার পুলিশকে বলা হয়েছে রোগীকে হাসপাতালে আনা-নেয়াসহ যেকোনো মানবিক কাজে যেন সহযোগিতা করা হয়। সেই মোতাবেক পুলিশ সদস্যরাও কাজ করছেন। এমনকি তারা মানবিক ত্রাণ সহায়তা নিয়েও বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষও এখন যে কোনো প্রয়োজনে পুলিশ ছাড়া আর কাউকে আপন ভাবতে পারছে না। এ যে ভালোবাসাটা সাধারণ মানুষ দেখাচ্ছেন সেটা এমনি এমনি নয়। এই কঠিন সময়ে পুলিশ সদস্যরা তাদের কাজের মাধ্যমে সেই ভালোবাসাটা অর্জন করেছেন।

শুধু কি তাই? সরকার ঘোষিত ঘরে থাকার নির্দেশ এবং সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণের দায়িত্বের পাশাপাশি পুলিশ এমন কোনো কাজ নেই যা করছে না।